ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

সংস্কৃতি ভুবনের এক নিঃসঙ্গ শেরপা সন্জীদা খাতুন

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

সংস্কৃতি ভুবনের এক নিঃসঙ্গ শেরপা সন্জীদা খাতুন

আমৃত্যু মানবিক ও মুক্তচিন্তার সমাজ বিনির্মাণে রেখে গেছেন অনন্য ভূমিকা। সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে ছড়িয়েছেন সম্প্রীতির বারতা। সুরকে হাতিয়ার করে লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সম্প্রীতি ও প্রগতির দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কেটে গেছে মানবতার এই আজন্ম সাধকের প্রতিটি দিন। সেই কীর্তিমান হলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন। শুক্রবার বৈশাখী সন্ধ্যায় স্মরণ করা হলো প্রয়াত এই রবীন্দ্র গবেষক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ও লেখককে। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে ও নাচের নান্দনিকতায় সজ্জিত ‘নতুন করে পাব ব’লে’ শীর্ষক স্মরণের আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয় ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে।শুরুতে সমবেত নৃত্যগীতের আশ্রয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় সন্জীদা খাতুনকে। কণ্ঠশিল্পীরা কণ্ঠে তুলে নেন গান। সকলে মিলে গেয়ে শোনায় কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে/তুমি ধরায় আসো ...। সেই সুরের আবেশে পরিবেশিত হয় বৃন্দ নাচ। পুরো আয়োজনজুড়ে মঞ্চের পেছনের পর্দায় ভেসে বেড়িয়েছে সন্জীদা সংস্কৃতিনির্ভর বর্ণিল কর্মযজ্ঞের নানা মুহূর্তের ছবি। সন্জীদা খাতুনকে নিবেদিত কথনে তাকে নতুন করে পাওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, তার ছায়াটা সরে গেল। আজ থেকে ছয় দশকেরও বেশি সময় আগে কবি সুফিয়া কামালের ছায়ায় সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হকসহ কিছু সাহসী বাঙালি স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করেন।  তারা গান ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে সর্বজনের মাঝে বাঙালি জাতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণের প্রয়াস নিয়েছিলেন। অভিশপ্ত উপমহাদেশের ইতিহাসে যখন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ সংঘাত ও বিদ্বেষে রূপ নেয় তখন তাদের তাগিদ ছিল সমাজে সম্প্রীতি সৃষ্টি করা। সুফিয়া কামাল ও ওয়াহিদুল হক চলে যাওয়ার পর ৬৮ বছর সংস্কৃতি ভুবনের এক  নিঃসঙ্গ শেরপা হিসেবে দুর্গম পথের যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন সন্জীদা খাতুন। তাই তার ছায়াটা কেবল ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী কিংবা কণ্ঠশীলন  থেকে সরে যায়নি। বরং বাঙালির আবহমান সংস্কতিকে যারা ধরে রাখতে চান তারা সকলেই এই মহীরুহের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করা, রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করলে প্রতিবাদে অনুষ্ঠান করা  কিংবা নজরুল খন্ডিত হলে প্রতিবাদ করার স্পর্ধাটি সন্জীদা খাতুন পেয়েছিলেন তার পিতৃগৃহে। তিনি ছিলেন বিপরীত স্রোতের মানুষ। স্পর্ধা ও সাহস নিয়ে সংগীত বিদ্যায়তন গড়েছেন। যখন বিনোদন হয়েছে বাণিজ্যিনির্ভর তখন  তিনি শিল্পী তৈরি করেছেন। ২০০১ সালে যখন অপশক্তি রমনা বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তখন তিনি বলেছেন, আমরা ত্রস্ত ও সন্ত্রস্ত নই। নতুন উপলব্ধি থেকে  বলেছিলেন, শুধু গান গেয়ে কাজ হবে না, শিক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে। এরপর গড়লেন নালন্দা বিদ্যালয়। এই বটবৃক্ষটি চলে গেছেন। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মানুষের ভরসাস্থল ছিলেন সঞ্জীদা খাতুন। ছায়ানট ও রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ কী সন্জীদা খাতুনের সেই ছায়াকে ধরে রাখতে পারবে? সেটা অসাধ্য নয়। যে ছাত্রীটি রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলনে প্রতিযোগিতা করেছে, মক্তবের যে ছেলেটি গান গেয়ে তাকে স্মরণ করেছে তাদের সকলকে যুথবদ্ধ হতে হবে। সকলে মিলে সহিষ্ণু সমাজ গড়তে হবে। তাহলেই তার ছায়াটি অপসৃত হবে না। সেই বাস্তবতায় মিনু আপাকে (সন্জীদা খাতুন) নতুন করে পাব বলে তাকে হারাই বারে বারে ...।কথন শেষে সম্মেলক কণ্ঠে  গাওয়া হয় ‘পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে’। পরিবেশিত হয় সন্জীদা খাতুনের কণ্ঠে ধারণকৃত গান ‘এখনো গেল না আঁধার’। সন্জীদা খানের লেখা প্রবন্ধ থেকে পাঠ করেন বাচিকশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর সন্জীদা খাতুন স্মরণে বক্তব্য রাখেন ছায়ানটের উপদেষ্টা মফিদুল হক। তানিয়া মান্নান শুনিয়েছেন ‘মালা হতে খসে পড়া’ শীর্ষক সংগীত। রোকাইয়া হাসিনা নীলি গেয়েছেন ‘আরো আরো প্রভু’। যেতে যেতে একলা পথে শীর্ষক গান শুনিয়েছেন মহিউজ্জামান চৌধুরী। সন্জীদা খাতুনের লেখা স্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতিভাবনা শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ পাঠ করেন সুমনা বিশ্বাস। মুগ্ধতার আবেশে শ্রোতারা শুনেছেন সনজীদা খাতুন পরিবেশিত সংগীত ‘আমি গগন  গহনে সন্ধ্যাতারা’। খায়রুল আনাম শাকিল গেয়েছেন ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’। ইফ্ফাত আরা দেওয়ান  শুনিয়েছেন ‘তোমারই তুলনা তুমি প্রাণ’। এছাড়াও একক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সৃষ্টিত সংগীত পরিবেশন করেন শারমিন সাথী ইসলাম ময়না, লিলি ইসলাম, প্রমীলা ভট্টাচার্য্য, এটিএম জাহাঙ্গীর, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা। পরিবেশিত হয়েছে ব্রতচারী গান ‘আয় মোরা সবাই মিলে’। পাঠ ও আবৃত্তি পরিবেশন করেন ত্রপা মজুমদার ও জহিরুল হক খান। সন্জীদা খাতুনের রচনা থেকে আলেখ্য উপস্থাপন করে নালন্দা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

রাজু

×