
ছবি: সংগৃহীত
প্রথাগত বলিউডের “শোভন, লাজুক এবং পুরুষ-নির্ভর” নায়িকার ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এই নতুন নারীকেন্দ্রিক ছবিগুলো একটি বিকল্প বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই চলচ্চিত্রগুলো কি ভারতে আদৌ মুক্তি পাবে? আর দর্শকরা কি এগুলো দেখতে আগ্রহী হবেন?
২০২৪ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত কারন কন্ধারির 'সিস্টার মিডনাইট'–এ অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে। ছবিতে তাঁর চরিত্র উমা একটি অনিচ্ছাকৃত বিবাহে আটকে পড়া এক নারী, যিনি নিজের স্বামীকে বলে বসেন, “তুমি দুর্গন্ধ ছড়াও”, আর গৃহকর্মীর চাকরি দেওয়া হলে রসিকভাবে জানান, তিনি একজন “গৃহদেবী”। ছবির সাউন্ডট্র্যাক, ব্যতিক্রমী সংলাপ ও শারীরিক কমেডি মিলিয়ে এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আপ্তে বলেন, “উমা এমন এক চরিত্র, যা আমি আগে কখনও পড়িনি। ও নিজেকে যেভাবে গ্রহণ করে, সেটাই ওকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।”
বলিউড, যেটি প্রতিবছর প্রায় ১.৩৬ বিলিয়ন ডলার আয়ে করে, বরাবরই নারীদের চিত্রায়ণে ‘প্রথাগত ও পশ্চাদপদ’ বলে সমালোচিত। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ বলিউড ছবিতে নারীদের একটি ‘ফর্মুলা’ মেনে দেখানো হয়—চুপচাপ, সুন্দরী, অর্ধনগ্ন পোশাকে আধুনিক, কিন্তু গোপনে ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘পাঠান, ‘জওয়ান’ বা ‘অ্যানিমাল’-এর মতো ছবিগুলোতে ‘আলফা মেল’ চরিত্ররা পেশি ও অস্ত্র নিয়ে দুর্ধর্ষভাবে শত্রু ধ্বংস করেন। ‘অ্যানিমাল’ ছবির নির্মাতা সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গার আগের ছবি ‘কবীর সিং’ও নারীর ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বিতর্কিত হয়েছিল।
তবে ছবির জগতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। যেমন ‘সন্তোষ’-এ দেখা যায় এক দলিত নারী (ভারতের নিম্নবর্ণ শ্রেণি) স্বামীর মৃত্যুর পর পুলিশের চাকরিতে ঢুকে পড়েন এবং এক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে দুর্নীতির মুখোমুখি হন। নির্মাতা সন্ধ্যা সুরি জানান, ২০১২ সালের দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনা তাঁকে এই গল্প তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে।
সুরি বলেন, “আমি দেখতে চেয়েছিলাম, একজন গৃহবধূর জীবন থেকে বেরিয়ে যদি কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছায়, তবে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়? এটা শুধুমাত্র পুরুষ হয়ে ওঠার বা নিপীড়নের গল্প নয়, নারীত্বের একটি ভিন্ন পথ কি তৈরি করা সম্ভব?"
‘সন্তোষ’ যদিও ব্রিটেনে অস্কার মনোনয়নের জন্য জমা দেওয়া হয়, ভারতে ছবিটি সেন্সর বোর্ডের কাটছাঁটের কারণে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
২০১৭ সালে ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ ছবি ‘অত্যধিক নারীকেন্দ্রিক’ বলে নিষিদ্ধ হয়েছিল, যদিও পরে মুক্তি পায়। এমনকি জনপ্রিয় ছবি ‘পুষ্পা’-তেও দৃশ্য কাটতে হয় যেখানে নায়ক নায়িকার শরীরে হাত রাখেন। বলিউডের মূলধারায় নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা দেখানো এখনও একটি ‘বিপজ্জনক’ এলাকা।
এই প্রেক্ষাপটে পায়েল কপাডিয়ার ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট’ হয়ে ওঠে আরও সাহসী। ছবিতে এক নার্স নিজের অবহেলিত বিবাহ ও এক তরুণী সহবাস করতে চাওয়া প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এক অন্তরঙ্গ, চিন্তনশীল চিত্রনাট্য। যদিও ছবিটি কান উৎসবে গ্র্যান্ড প্রি পুরস্কার জেতে, ভারতীয় অস্কার কমিটি এটিকে ‘ইউরোপীয় ঘরানার ছবি’ বলে বাতিল করে।
তবে এই ধরনের স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলো ভারতের মূলধারার দর্শকের কাছে এখনও খুব বেশি গ্রহণযোগ্য নয়। সমালোচক শুভ্রা গুপ্ত বলেন, “যদি কেউ দেখেন একজন দলিত নারী গল্পের মূলচরিত্র, বা কেউ স্বামীর অধীনে না থেকে নিজের মতো চলেন, তখন সেটা অনেকের কাছেই 'অবিশ্বাস্য' মনে হয়।”
বাঙালি নির্মাতা তনুশ্রী দাস ও সৌম্যনন্দ সাহির ‘শ্যাডোবক্স’ নামক ছবিতে মধ্যবিত্ত এক নারীর সংগ্রামের গল্প উঠে আসে। তনুশ্রী বলেন, “যাদের বলা হয় সমাজের প্রান্তে, তাদের সংখ্যাই আসলে আমাদের দেশের বৃহৎ অংশ। তাহলে তাদের গল্প কোথায়?”
শেষ পর্যন্ত, সিনেমা হোক বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নারী নির্মাতারা ও সাহসী চরিত্ররা বলিউডের পুরনো কাঠামো ভাঙতে শুরু করেছেন। সময়ের চাহিদা হলো—এই গল্পগুলো যেন শুধু উৎসবে নয়, দর্শকের ঘরেও পৌঁছে যায়।
শহীদ