ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৬ চৈত্র ১৪৩১

সাগর দেওয়ান

সুফিগান ও বাউলশিল্পী

ড. আমিনুর রহমান সুলতান

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ২৭ মার্চ ২০২৫

সুফিগান ও বাউলশিল্পী

সুফি মতবাদের বিশেষজ্ঞগণের মতে-১. আরবি ‘স্বফা’ ধাতু থেকে উৎপত্তি হয়েছে ‘সুফি’ শব্দের। এর অর্থ ‘পবিত্রতা’। যিনি তার জীবনযাপনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে নিজেকে ‘অন্তরের ও বাইরের’ জগতের দিক থেকে পবিত্রতা ধারণ করেন তিনি ‘সুফি’ হিসেবে খ্যাত। ২. বিভিন্ন ধরনের পরিধেয় কাপড়ের মধ্যে রয়েছে পশমি। পশমি যারা পরিধান করতেন, তাদেরকে সুফি বলা হয়, এখানে সুফি পশমি অর্থে ব্যবহৃত। তারা তত্ত্বজ্ঞানী।
সুফিগণ মনে প্রাণে বিশ^াস করেন যে, সুফির যিনি সৃষ্টিকর্তা তার বিশেষত্ব এখানেই যে, তিনি সকল সৃষ্টিজীবের সৃষ্টিকর্তা। বিশেষ কোনো জাতির বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকর্তা নন। সৃষ্টিকর্তা মানেই প্রতিপালক। একত্ববাদেরই প্রাধান্য সুফির জগতে। তবে পথ প্রদর্শক হিসেবে গুরু অনন্য ভূমিকা পালনকারী। সুফি মতবাদে বিশ^াসী বাউলশিল্পী বা গান রচয়িতাগণের কাছে মানব আত্মা ও শরীর খুবই গুরুত্ব পায়।
শরীর মাটির তৈরি, মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত শরীর বিলুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু আত্মার মুক্তি বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে নয়, উচ্চতর ‘সোপানে’ পৌঁছনোর মধ্যে রয়েছে মুক্তি। আর এই মুক্তি সম্ভব দেহভাণ্ডকে কেন্দ্র করে। কারণ, দেহের সঙ্গে রয়েছে মনের সংযোগ। অবচেতন মনের জায়গা দখল করে থাকে ‘কাম, মোহ, লোভ, ক্রোধ, মদ ও মাৎসর্য।’ মন থেকে তা সরিয়ে সংবরণ চর্চার জন্য দেহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মনের যে দোলাচলতার সেতু কোনটিতে মানবের পরম মুক্তির পথ নির্মাণের সূত্র গ্রথিত তা জানার জন্য সঠিক সেতুরই সন্ধান করতে হয়। কিন্তু ক’জনেই বা পারে? পারে না বলেই সাগর দেওয়ানের সুফিগানে আক্ষেপ বেড়ে যায়, উচ্চারিত হয়-
‘মনের দোটান গেল না আর।
রঙের মায়াছলে।’
দেহ কেন্দ্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে সুফিবাউলরা চান পরমাত্মার সন্ধান। পরমাত্মার সন্ধানে জ্ঞানমার্গকে উঁচু স্তরে নিয়ে যেতে হয়। পথটি সহজ ও সাবলীল নয়। গুরুভক্তি ও গুরুর স্মরণে পথটি সুগম হয়। কিন্তু এই পথটি অন্ধহস্তীর প্রেম দর্শনের মতো হয়ে ওঠে যথার্থ আধ্যাত্মিক শক্তি সামর্থ্যরে অভাবে।
সামর্থ্যবান হওয়ার সাধনায় মন্ত্র নয়, তন্ত্র নয়, তত্ত্বজ্ঞান আহরণ ও সুরক্ষার প্রয়োজন। তত্ত্বজ্ঞানে পঞ্চেন্দ্রিয় শুধু উপলব্ধির জগতকে শনাক্ত করে না, দেহভাণ্ডের দ্বার উন্মোচনের মধ্য দিয়ে পার্থিব জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করায়। জ্ঞানের রয়েছে নানা স্তর। সামর্থ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে পরমাত্ম জ্ঞানে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।
দেহকে কেন্দ্র করে যে উত্তরণের সীমা রেখা অতিক্রম করার সাধনা সে সাধনায় আত্মজ্ঞানে পূর্ণতা পেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা পরমাত্মার বিকাশ লাভ ঘটে। এরই লক্ষ্যে সাগর দেওয়ানের সাধনা, জ্ঞানচর্চা, তত্ত্বজ্ঞান, পার্থিব জগত মাড়িয়ে বিশাল জগতের সন্ধান করা-ফলে তার বাণী শুধুই বাণী নয় সুফিদর্শনের নবনির্মিতি হয়ে ওঠে। তাঁর বাণী
শূন্য দেহ ভেসে গেল
আবার আসবে বলে॥
সুফির জগত প্রেমের জগত, ভক্তির জগত। সুর ও বাণীর সুসম্বয়ে একাগ্রচিত্তে নিজেকে নিজের ভিতর বিলীন করে দেন সুফি বাউল সাধক ও গায়কেরা। এর জন্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে সাধু সঙ্গের। সুফিগানের পরম্পরায় বাউলশিল্পী সাগর দেওয়ানের সুফি গানের সংকলনের আয়োজন আমারই সম্পাদনায় সম্পন্ন হয়েছে। গ্রন্থটির শিরোনাম ‘সুফিগান ও জীবনকথায় সাগর দেওয়ান।’
সুফিবাদ/গুরুবাদ বিষয়বস্তু নিয়েই রচিত হয় সুফি গান। যা শ্রবণ করা এবং গাওয়া দুটোই পরমকে কাছে পাওয়ার সহজ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সেই সুবাদে সাগর দেওয়ানও তার পরিপূর্ণতা পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটি তাঁর শিল্পী জীবনের কাছে সহজ ভাষায় ইবাদাত।
২.
একটি পরিবারের উপার্জনশীল একমাত্র ব্যক্তিটি বা একমাত্র অভিভাবকের মৃত্যু হলে সে পরিবারের টানাপোড়েনে পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়ে। ভাঙন আশঙ্কাকে প্রভাবিত করে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মানুষের মৌলিক চাহিদার সবকটিতেই ঘাটতি পড়ে। তবে সময় সাপেক্ষে সিংহভাগ চাহিদাগুলো পূরণে সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। শিক্ষা জীবনের অনিশ্চয়তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এমনটিই ঘটেছিল বাউলশিল্পী সাগর দেওয়ানের পরিবারটিতে।
বাবা খ্যাতনামা বাউলশিল্পী ও সাধক খবির দেওয়ান। দেওয়ান ঘরানার চতুর্থ প্রজন্মের সন্তান। সাগর দেওয়ান দ্বিতীয় প্রজন্মের খালেক দেওয়ানের বড়ো ভাই মালেক দেওয়ানের পুত্র তিনি। দাদা আলফু দেওয়ান বামনসুরের দেওয়ান বাড়ি ও দেওয়ান ঘরানার পালাগানের প্রতিষ্ঠাতা।
সাগর দেওয়ানের তিন ভাই ও দুই বোন। বড় বোন- স্মৃতি দেওয়ান, রুনা, বড় ভাই- রাকিব উদ্দিন দেওয়ান, তারেক দেওয়ান অরুণ, ছোট বোন- সালমা দেওয়ান বিনা। তার সহধর্মণীর নাম-ফারিয়া ইসলাম মাহিন। প্রখ্যাত বাউলশিল্পী আরিফ দেওয়ান তার বৈমাত্রেয় ভাই।
সাগর দেওয়ানের নানাবাড়ি সোনারগাঁওয়ের সমমানদি গ্রামে। তার নানার নাম মালা ফকির (গাজী)। মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। তরিকাপন্থী উদার ও সুফি প্রেমাদর্শনের মালা ফকির ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই ছিলেন খবির দেওয়ানের শিষ্য ও ভক্ত। আর এই সূত্রে মালা ফকিরের বাড়ির অতিথি হয়েছেন একাধিকবার। মালা ফকিরের কন্যার সঙ্গে খবির দেওয়ানের বিয়ের বিষয়টি স্বাভাবিক ছিল না।
খবির দেওয়ান সুফি সাধক ও খ্যাতিমান পালাকার ও বাউলশিল্পী হওয়ায় বহু গুণগ্রাহী ভক্ত ও শিষ্যকে কাঁদিয়ে ২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালে।
আলেপচান দেওয়ান অর্থাৎ আলফু দেওয়ানের পুত্রদ্বয়ের মালেক দেওয়ানের পুত্রদের মধ্যে খবির দেওয়ান এবং খালেক দেওয়ানের পুত্রদের মধ্যে মাখন দেওয়ান ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান পরিবারের লোকজনের ধারায় পালা ও বাউলগান ধারণ করে দাদার সৃষ্ট পথ এবং বাবা চাচার মাধ্যমে সে দায় দেশব্যাপী বিস্তারকে অধিকতর বিস্তারে সামর্থ্যবান হয়ে ওঠেন।
খবির দেওয়ানের মৃত্যুর পর অর্থাৎ সাগর দেওয়ানের বাবার মৃত্যুর পর তাদের পরিবারটি জীবনের বাস্তবতার যে অনিশ্চয়তা, টানাপোড়েন, ভাঙন সে অভিজ্ঞতায় জারিত হতে থাকে।
সাগর দেওয়ান জন্মেছিলেন ১৯৯৯ সালে ১লা সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবার মৃত্যুর বছর বয়স ছিল ৮ বছর। তাঁর জন্ম হয়েছে কেরানীগঞ্জের আঁটি বাজারের কাছে পাঁচদোনায়। পাঁচদোনায় জন্মের পর তিন বছর ছিল পরিবারটি। এর আগে তার মা-বাবার বিয়ের বছর পরিবারটি ছিল শাজাহানপুরে। এখানেই তার বড় বোন রুনা দেওয়ানের জন্ম হয়। সময়টা নব্বইয়ের দশক। তারপর বাবা বদল হয়ে চলে আসে মোহাম্মদপুর। সেখান থেকে পাঁচদোনা। পাঁচদোনা থেকে পাশেই নয়া বাজারে আবার চলে আসে পরিবারটি বাসা বদল করে। এখানে নয়াবাজার সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন ২০১৬ সালে। বাল্যকাল থেকেই বাউলশিল্পী আরিফ দেওয়ানের সঙ্গে পালাগানের ও বাউলগানের আসরে গান বাজনার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন সাগর দেওয়ান।
একজন সংগীত রচয়িতা এবং সুরকার সর্বদা ভিন্ন কিছু সৃষ্টির খোঁজে থাকেন। যেমন কবি নজরুল তার সৃষ্টিতে। গান, সুর, রাগ, তাল, কবিতা ইত্যাদি অনেক কিছু রয়েছে যা থেকে সাগর দেওয়ান অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তার মন্তব্য, ‘আমার এতটুকু সময়ে যা গান লিখা হয়েছে চেষ্টা করেছি লিখা এবং সুরের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করার।
আমার একটি গান যা লিখা এবং সুর করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৪শে মে। গানের কথা
সুরের ভুবনে রাত সেজেছে
এ কোন রঙে
এই গানটির সুরের মধ্যে আমি ছয়টি রাগের চলন ঘটিয়েছি। যেমন
টোরি, যোগ, ভৈরব, পূরবী, মালকোষ, বাগেশ্রী।
এছাড়াও আমার এমন কিছু গান রয়েছে যার রাগের ক্ষেত্রে এমন রাগ ব্যবহৃত হয়েছে যা বাংলা গানে এর আগে হয়নি। যেমন
গান  ভাবনা দিলো মজনু করে
রাগ চন্দ্রকোষ
এমনিভাবে অনেক রাগের ব্যবহার আমি আমার গানের সুরে ব্যবহার করে আসছি। যেমন
রাগ যোগ, ভৈরবী, কলাবতী, দেশ, ইমন কল্যাণ, আহেরী ভৈরব, টোরি, বৃন্দাবনী সারং, কাফি ইত্যাদি।’
বাংলার জমিনে সর্বপ্রথম পালাগানের সৃষ্টি দেওয়ান ঘরানা থেকেই যার স্রষ্টা দেওয়ান আলেপ চান শাহর সুযোগ্য দুই পুত্র মালেক দেওয়ান ও খালেক দেওয়ান।
দেওয়ান বংশের এই ধারাবাহিকতা চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত একই ধারায় বহমান। বলা যায়, কয়েকটি প্রজন্ম চেষ্টা করে যাচ্ছে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ ধরে রাখার এবং লালন করার। দেওয়ান ঘরানার পালাগান ও বাউলগান সম্পর্কে সাগর দেওয়ান বলেন- ‘আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই বহালে থাকবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কেননা, এই ঘরানার বাইরে বাংলায় আর যে সমস্ত পালাকার এখন দেখা যায় তাদের রুচিবোধের সঙ্গে এক হয়ে চলা অসম্ভব।’
সাগর দেওয়ান পালাগানের বিষয়ভিত্তিক যথোপযুক্ত বাউলগানসহ বাউল আঙ্গিকের তত্ত্বজ্ঞানভিত্তিক গান লিখেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য- বন্দনা গান, নবীজির শান, খাজাবাবার শান, মনোশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, রাধা পক্ষ, শিষ্যপদ, ভক্তিবাদ, ভক্তিমূলক, বাবার স্মরণে, জীবের গান, হাশর, নূরতত্ত্ব,  আত্মতত্ত্ব, গুরুবাদ, অন্যান্য গান প্রভৃতি।
সুফিগান ও জীবনকথা সাগর দেওয়ানের প্রেম ও ভক্তি সত্তায় বিকশিত। তার সুফিগান মূলত তার জীবন কথারই আয়না। যার একদিকে পারদমাখা। অন্যদিকে স্বচ্ছ টলমল জলের মতো কাচ। নিজেকে দেখার স্বচ্ছকাচ।

×