ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩১

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’

সাম্য ও ঐক্যের সুর

মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ২৭ মার্চ ২০২৫

সাম্য ও ঐক্যের সুর

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, যিনি ইসলামী ভাবধারার গান ও কবিতার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের চেতনায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছেন। তার রচিত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি বাংলার মুসলিম সংস্কৃতিতে ঈদ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এ প্রবন্ধে গানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব, ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও কুরআন-হাদিসের আলোকে এর শব্দ ও বাক্যগঠনের বিশ্লেষণ প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি ঈদের আনন্দকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। এটি প্রথমবার ১৯৩১ সালে ঈদ উপলক্ষে রচিত ও সুরারোপিত হয়। গানটির মধ্য দিয়ে ইসলামী মূল্যবোধ, দানশীলতা, ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সাম্যবাদের যে বার্তা উঠে এসেছে, তা বাংলা ভাষায় ঈদ উৎসবের এক অনন্য সাংস্কৃতিক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ গানের প্রতিটি লাইনে নজরুল কুরআন ও হাদিসের মৌলিক নীতিসমূহ অক্ষরে অক্ষরে ধারণ করেছেন এবং সে বর্ণনাসমূহ এই গানে স্থান পেয়েছে। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য সংযম ও আত্মশুদ্ধির সময়। কোরআনে বলা হয়েছে, “হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” ঈদুল ফিতর হচ্ছে রমজান মাসের শেষে ধৈর্য ও সংযমের প্রতিদানস্বরূপ প্রাপ্ত আনন্দ। ঈদুল ফিতরের এই আগমন ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’-এ প্রকাশ পেয়েছে।
“তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ”-এ ইসলামে আত্মত্যাগ ও পরোপকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “মুমিনদের মধ্যে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ, যে অন্যের জন্য কল্যাণকর।” “শোন আসমানী তাগিদ”-এ কুরআন ও হাদিসে জাকাত নিয়ে যে আহ্বান করা হয়েছে-তা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ঈদের দিনে আত্মত্যাগ ও দানশীলতার গুরুত্বের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
রমজান ও ঈদের সময় দান করা এক মহত্বের কাজ এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এসময়ে দানের সওয়াব অনেক বাড়িয়ে দেন এবং এ দান তথা জাকাত দারিদ্র্য বিমোচনে এর ভূমিকা অনেক। তাই নজরুল সবাইকে বেশি বেশি দান, সদ্কাহ দিতে ও জাকাত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বললেন, “তোরা সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ”-এখানে ইসলামি বিধান জাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা  করে, তারা কী খরচ করবে? বল, যা কিছু অতিরিক্ত থাকে।”
কাজী নজরুল ইসলামের পঙ্ক্তি “তোরা সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ”-মূলত তার বিপ্লবী ও সুফিবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটায়। এ পঙ্ক্তিটির নানা মাত্রার বিশ্লেষণ করা যায়। উল্লেখ্য: ১. ইসলামী সুফিবাদ ও দানশীলতা: “রাহে লিল্লাহ”-এর অর্থ আল্লাহর পথে দান করা। ইসলামী সুফি চিন্তাধারায় পার্থিব সম্পদের প্রতি মোহ-মুক্তি এবং আল্লাহর পথে আত্মনিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নজরুল এখানে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধীতা করে দেখাচ্ছেন যে, মানুষের ঐশ^র্য ধন-সম্পদ, প্রসাদÑএসবই ক্ষণস্থায়ী এবং এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই দান, যা তাঁর রাস্তায় উৎসর্গ করা উচিত। ২. বিপ্লবী চেতনা ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: নজরুল সাম্যবাদী আদর্শে বিশ^াসী ছিলেন। এই পঙ্ক্তির মাধ্যমে তিনি সমাজের অভিজাত শ্রেণির প্রতি ইঙ্গিত করে বলতে চেয়েছেন যে, সম্পদশালী ব্যক্তিরা যে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে, তা মূলত দরিদ্র জনগণের সম্পদের ওপর ভিত্তি করে ওঠে। তিনি মনে করেন, এসব সম্পদ সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত, ব্যক্তিগত ¯া^র্থে নয়। ৩. শোষণ ও সাম্যবাদের আহ্বান: নজরুল তার এ গানে বারবার ধনী-গরিব বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। এই পঙ্ক্তিতে তিনি মূলত সম্পদের অস্থায়ী প্রকৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, শোষণের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ একসময় ধ্বংস হবে, তাই এসব ধন-সম্পদ মানুষের সেবায় নিয়োজিত করাই শ্রেয়। ৪. সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ: নজরুল কেবল একজন কবি নন, তিনি একজন সমাজচিন্তকও। তার রচনায় নৈতিকতা, দানশীলতা ও মানবসেবার গুরুত্ব উঠে এসেছে। এই পঙ্ক্তির মাধ্যমে তিনি লোভ-লালসার বিপরীতে নৈতিকতা ও মানবকল্যাণের আহ্বান জানিয়েছেন। অতএব, নজরুলের এই পঙ্ক্তি একদিকে সুফিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সাম্যের ধারণার প্রতিফলন। এখানে তিনি মানুষকে পার্থিব সম্পদের মোহ ত্যাগ করে মাহান আদর্শের পথে চলার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে প্রকৃত সম্পদ ব্যক্তিগত বিলাসিতা নয়, বরং মানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়াই শ্রেষ্ঠ গুণ। কাজী নজরুল ইসলামের গানটি দানশীলতার তাগিদ প্রদান করছে।
“আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে।”-এ পঙ্ক্তিতে নজরুল ইসলামে শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে বাণী দিয়েছে, তাই উচ্চারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেছেন, “ঈদের দিনে পুরুষ ও নারীরা যেন ঈদগাহে সমবেত হয় এবং আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করে।” এখানে ঈদের নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে সবাই আপন এবং সমান অবস্থানে আসীন হবে।
ইসলাম শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। নবী (সা.) বলেছেন, “দুই মুসলিম যখন একে অপরের সঙ্গে করমর্দন করে, তখন তাদের গুনাহ মাফ করা হয়।” “আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে”Ñ এই লাইনটিতে সমাজে সম্প্রীতি ও ঐক্যের আহ্বান রয়েছে। এই পঙ্ক্তিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মানবতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সাম্যের আহ্বান। এই পঙ্ক্তিটি মূলত ঐক্য, সম্প্রীতি এবং বিভেদ ভুলে পারস্পরিক সহযোগিতার আহ্বানকে নির্দেশ করে।  
নজরুলের এই পঙ্ক্তি কেবল তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটের জন্য নয়, বরং সার্বজনীন এক বার্তা বহন করে। এটি মানবিক মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য এবং শান্তির আহ্বান জানায়, যা সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। বর্তমান বিশে^র যেখানে বিভেদ, বিদ্বেষ ও সংঘাত চলছে, সেখানে নজরুলের এই বার্তা নতুন করে মনে করিয়ে দেয় যে, শত্রুতা ভুলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য গড়ে তোলাই প্রকৃত মানবতার পরিচয়।
ইসলাম ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “সর্বোত্তম মুসলিম সেই, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।” গানটির “তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা, সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।” এই অংশে প্রতিহিংসার পরিবর্তে ভালোবাসা ও সহানুভূতির শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
এই গানটি শুধুমাত্র একটি গান নয়, বরং এটি ইসলামী শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার, দানশীলতা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিফলন। কোরআন ও হাদিসের আলোকে গানটির প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি ইসলামি মূল্যবোধের এক সমৃদ্ধ প্রতিচ্ছবি। ঈদের দিনে এটি শুধু আনন্দের প্রতীক নয়, বরং মুসলমানদের জন্য একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা।

×