
ছবিঃ সংগৃহীত
যাত্রাপালা বা নাটক আবহমানকাল থেকে গ্রামের মানুষকে আনন্দ-বিনোদন দিয়ে আসছে। তখন বিনোদনের খোরাক ছিল যাত্রাপালা। যাত্রাপালা লোকসাহিত্যের একটি বিরাট অংশ নিয়ে বিরাজমান। যাত্রাপালার মধ্যে খাইরুন সুন্দরী, নসিমন, রসিয়া সুন্দরী, রূপবান, কাশেম মালার প্রেমসহ অসংখ্য পালা রয়েছে।
কালের আবর্তনে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষেরা আধুনিক টিভি, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এসব যাত্রাপালার পরিবর্তে দেশি-বিদেশি সিনেমা-নাটক দেখেন। গভীর রাত জেগে শীতের রাতে যাত্রাপালা দেখার কী যে মজা, তা এখন বলে বুঝানো যাবে না। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা। সেসময় বিনোদনের অন্যতম উৎসই ছিল এ যাত্রাপালা।
সূত্রমতে, ১৫শ থেকে ১৬শ শতকের মধ্যভাগে যাত্রাপালা বাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি তখন কেবল ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয় বরং বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, ও গোবিন্দ দাসের রচনাগুলো যাত্রার গল্পের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এছাড়া, মহাভারত, রামায়ণ এবং অন্যান্য পুরাণ থেকেও যাত্রাপালার জন্য গল্প নির্বাচন করা হতো।
যাত্রার অভিনয়ে অভিনব রীতিতে পরিবেশিত হতো নাটক। অভিনেতারা সাধারণত খুব উঁচুস্বরে সংলাপ পাঠ করতেন এবং তাদের অঙ্গভঙ্গি ও মুদ্রা ছিল অত্যন্ত নাটকীয়। দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলার জন্য এই অভিনয়শৈলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। যাত্রাপালার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এর গান ও নৃত্য। মূল নাটকের অংশ হিসেবে গান ও নৃত্যের ব্যবহার যাত্রাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতো।
১৮শ থেকে ১৯শ শতকের প্রথমভাগে যাত্রাপালা বাংলায় এক স্বর্ণযুগের সূচনা করে। এই সময়ে যাত্রার বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পৌরাণিক গল্প ছাড়াও, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে যাত্রাপালা রচিত হতে শুরু করে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো ব্যক্তিত্বরা যাত্রার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাদের লেখা যাত্রাপালা সমাজের নানা অসঙ্গতি ও কুসংস্কার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়েছিল।
বিভক্ত বাংলায় ৭০ দশকে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিলো এই যাত্রাপালা। আর যাত্রাপালার কাহিনী আর গল্পগুলো বেশির ভাগই সমাজে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়ে তৈরি করা হতো।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা যাত্রাপালা এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় গ্রাম বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনার চিত্র উঠে আসতো যাত্রাপালায়। আগে যাত্রাপালা দেখতে মানুষ আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে ভিড় করতো। আজ চিরচেনা সেই যাত্রাপালা আর চোখে পড়ে না।
যাত্রাপালার সঙ্গে জড়িত কিছু অসাধু লোকজনের কারণে জুয়া আর দেহ প্রদর্শনের কারণে যাত্রাপালাতে ভাটা পড়েছে। গুটি কয়েকজনের কারণে এ সংস্কৃতি আজ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে যাত্রা দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পেশা খুঁজে নিয়েছেন। অনেকেই অর্থ ও খাবারের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
চট্টগ্রামে এক সময় ২০/২৫টি যাত্রাপালার দল ছিল। এখন সেগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম ছাড়া যাত্রা শিল্পীদের কেউ খোঁজ রাখে না। এখন আর যাত্রাপালার ডাকও আসে না। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পীরা দুঃখ কষ্টে আছেন। সরকারের উচিত পুরোনো সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতে তাদের পাশে দাঁড়ানো। তা না হলে আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে যাত্রাপালা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ইমরান