
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর ৮ বিশিষ্টজনকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে সরকার। এবার মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর পুরস্কার পাচ্ছেন পপগুরু আজম খান।
আজম খান প্রথম যিনি ব্যান্ড সংগীত দিয়ে এদেশের মানুষের মাঝে আলোড়ন তোলেন। ১৯৭২ সালের কথা। সে বছর তিনি ও তার ব্যান্ড উচ্চারণ বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে গান করেন। অনুষ্ঠানটিতে তিনি এত সুন্দর দুনিয়া কিছুই রবে না রে এবং চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দুটি পরিবেশন করেন। প্রচারের পরপরই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে গান দুটি। তরুণ সম্প্রদায় যেন নতুন কিছু খুঁজে পায় তার গানে। সেখানে প্রেম ও ভালোবাসার তুলনায় আধিক্য ছিল দ্রোহ, সামাজিক অবক্ষয় ও আধ্যাত্মবাদের।
শুরু হয় বাংলা গানের দিন বদলের খেলা। এই খেলায় আজম খান সঙ্গী হিসেবে পান ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও পিলু মমতাজকে। সংগীতপ্রেমীদের কাছে তারা পরিচিত হয়ে ওঠেন পঞ্চপাণ্ডব নামে।
গানের মাধ্যমে দেশ ও সমাজের কথা বলতেন আজম খান। যুদ্ধ পরবর্তীকালে প্রিয় মাতৃভূমির বেহাল দশা দেখে কণ্ঠে তুলেছিলেন রেল লাইনের ওই বস্তিতে শিরোনামের একটি গান। গানটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন এক উন্মাদনার নাম। এরপর একে একে তার আরও অনেক গান শ্রোতাপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। সেই সঙ্গে নিজেও চলে যান খ্যাতির শিখরে। আজম খানের শ্রোতাপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ওরে সালেকা ওরে মালেকা,পাপড়ি, অভিমানী, আমি যারে চাই রে, এত সুন্দর দুনিয়া, অনামিকা, আসি আসি বলে, হাইকোর্টের মাজারে, পাপড়ি, বাধা দিও না প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ক্যারিয়ারে ১৭টির বেশি অ্যালবাম রয়েছে এই রক আইকনের। অ্যালবামগুলো দারুণভাবে ব্যবসফল ছিল। কিংবদন্তি এই রক গায়কের জনপ্রিয়তা শুধু নিজের দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পশ্চিমবঙ্গেও রকস্টার হিসেবে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আজকের কলকাতার ব্যান্ডশিল্পীদের অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণার নাম ছিলেন এই আজম খান।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই গায়ক গানের পাশাপাশি অভিনয় করেও বেশ প্রশংসা পেয়েছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি কালা বাউল নামের একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। পরে ২০০৩ সালে গডফাদার নামক একটি চলচ্চিত্রে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একজীবনে আজম খান পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার। এর মধ্যে বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার, কোকাকলা গোল্ড বটল পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। মৃত্যুর পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।
সংগীতের মতো দেশের প্রতিও আজম খানের ছিল গভীর প্রেম ও মমত্ববোধ। ১৯৭১ সালে প্রিয় মাতৃভূমি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অস্ত্র হাতে। রণাঙ্গনে তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক যোদ্ধা। সেসময় আজম খান ছিলেন দুই নাম্বার সেক্টরের একটি সেকশনের ইনচার্জ। সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশে কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন তিনি। তার প্রবল বিক্রমে রণাঙ্গনে দিশেহারা হয়ে পড়ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
২০১১ সালের ৫ জুন বাংলাদেশের এই পপ সম্রাটের জীবনাবসান ঘটে। আজন্ম যোদ্ধা আজম খান মৃত্যুপূর্ব এক বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে চলে যান না ফেরার দেশে। সাদামাটা জীবনের অধিকারী খ্যাতিমান এই গায়কের না থাকার ১৩ বছর। তবে তিনি আছেন তার গানে, আছেন শ্রোতাদের হৃদয়ে। বাংলা সংগীতের এই বরপুত্র বেঁচে থাকবেন তার উত্তরসূরিদের মাঝে। সেই সঙ্গে তিনি বেঁচে থাকবেন লাল সবুজের পতাকায়।
সাজিদ