ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১

রাজপথে যশোর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:১৭, ৬ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ২০:১৮, ৬ মার্চ ২০২৫

রাজপথে যশোর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ

সময়টা ছিল ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১২টা ৫০ মিনিট। ঘটনাস্থল যশোরের টাউন হল মাঠ। সেথায় চলছিল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ সম্মেলনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। একতারার মায়াবী সুরকে সঙ্গী করে পরিবেশিত হচ্ছিল বাউল গান।  আপন সংস্কৃতির অনুরাগী শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শুনছিলেন  মাটি ও মানুষের কথা বলা সেই গান। তবে  শেকড়সংলগ্ন সেই সুরের জগতে  নেমে আসে মানুষরূপী অসুরের আক্রমণ। চারপাশ কাঁপানো গগনবিদারী শব্দে ঘটে যায় প্রাণঘাতী বোমার বিস্ফোরণ।

প্রতিক্রিয়াশীলদের ওই বোমা হামলায় মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ে দশটি তাজা প্রাণ, আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ। ওই ঘটনার ভয়াবহতায় সকলের মতোই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যশোরের ফুল বিক্রেতারা। তারা বলেছিলেন, ‘এই শহরে ফুল বিক্রি করতে আমাদের ঘৃণা হয়।’ আর সেদিনের সেই নৃশংস ঘটনার শিল্পিত রূপটি উপস্থাপিত হলো শহর ঢাকার রাজপথে। বৃহস্পতিবার বসন্ত বিকেলে তোপখানা রোডের উদীচী চত্বরে পরিবেশিত হয় ভিন্নধর্মী এক নাট্যলেখ্য। অভিনয়শিল্পীদের উচ্চারিত সংলাপের সমান্তরালে গানের পরিবেশনা ও বক্তাদের বয়ানে মূর্ত হয় মর্মান্তিকতার সে দৃশ্যকল্প। সেই দৃশ্যের সূত্র ধরে নিবেদিত হয় যশোর হত্যাকা-ের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। 


যশোর হত্যাকা-ের ২৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে এই প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর একাংশ। এই সমাবেশে  সংগঠনের শিল্পীদের গান ও অভিয়ের মাধ্যমে যশোর হত্যাকা-ের শহীদদের  প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি ওই হত্যাকা-ের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ উচ্চারিত হয়। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা, তদন্তহীন বিচারের নামে প্রহসন, আহত-নিহতদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন উদীচী  কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি একরামুল কবীর ইল্টু, সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন ও সহ-সভাপতি হাবিবুল আলম। একরামুল কবীর ইল্টু ছিলেন সেদিনের অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। তিনি তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সেদিন যশোর টাউন হল মাঠে ছিল উচ্ছ্বসিত মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মধ্যরাত পেরিয়ে  গেছে কিন্তু মানুষের উৎসাহে  নেই কোন ঘাটতি। তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছিলেন বাউলদের পরিবেশিত গান। এমন সময় পূর্ব  থেকে পেতে রাখা শক্তিশালী টাইম বোমার প্রকা- বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে  গোটা যশোর শহর। মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। ল-ভ- চারপাশ, রক্তের  স্রোত বয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মানুষের  দেহ।

কারও হাত নেই, কারও পা  নেই, কারও নাড়ি-ভুরি  বেরিয়ে গেছেÑদেখে বোঝার উপায় নেই কে মৃত, কে জীবিত। 
জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, যশোর হত্যাকা-ের ২৬ বছর  পেরিয়ে গেছে কিন্তু আজও প্রকৃত হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের অওতায় আনতে পারেনি কোন সরকার, বিচারের নামে যা হয়েছে তা প্রহসন। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের আমলে ঘটা এই হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়ে গাফিলতির কারণে ঘটনার মূল অপরাধীরা পার  পেয়ে গেছে। ফলে মামলার রায় প্রদানের সময় বিষয়টি নিয়ে  ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আদালতের বিচারক। তিনি  বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে যশোর হত্যাকা- এ ধরনের প্রথম হত্যাকা-। যদি দ্রুততার ভিত্তিতে সঠিক তদন্ত করে এই হত্যাকা-ের বিচার করা সম্ভব হতো তবে পরবর্তীতে পল্টন ময়দানে  বোমা হামলা, রমনা বটমূলে  বোমা হামলা, নেত্রকোনা বোমা হামলা, সিরিজ বোমা হামলা এগুলো হতো না।

 
ঘটনার পুনঃতদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের দাবি জানিয়ে হাবিবুল আলম বলেন, ১৯৯৯ সালের পরে অনেক সরকার এসেছে-গেছে। কোনো সরকারই যশোর হত্যাকা-ের সঠিক বিচারতো করতে পারেনি। এমনকি নিহত ও আহতদের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের সামনে জনআকাঙ্খার নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বার উন্মোচন করেছে। নতুন বাংলাদেশে আমরা যশোর হত্যাকা-ের সঠিক বিচার  দেখতে চাই। গোটা অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা, পরিকল্পনা ও নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন- রহমান মুফিজ, বিজন রায়, সুরাইয়া পারভীন, আরিফ নূর, রবিউল ইসলাম শশী ও মীর সাখাওয়াত। 


এদিকে সকালে উদীচী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের যশোর হত্যাকা-ের প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ করে সংগঠনের আরেক অংশ।

শিহাব

×