ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১

কেন থমকে আছে কোক স্টুডিও বাংলা!

অনলাইন রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০৫:৩২, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কেন থমকে আছে কোক স্টুডিও বাংলা!

কোক স্টুডিও বাংলা

সাধারণত বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতের সংমিশ্রণ বা ফিউশনের মাধ্যমে যেভাবে কোক স্টুডিও'র গানগুলো তৈরি হয় এবং সঙ্গীতশিল্পী ও কলাকুশলীদের যেরকম লাইভ পারফর্মেন্স দিয়ে মিউজিক ভিডিও তৈরি হয়, তা দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোক গানগুলো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে পরিবেশন, এসব গানের আদি শিল্পীদের উপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে নতুন শিল্পীদের নতুন ধাঁচের পরিবেশনা–– এসব পছন্দ করতে শুরু করেন এই সময়ের তরুণেরা।

২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি 'কোক স্টুডিও বাংলা' থেকে  প্রকাশিত প্রথম গান 'একলা চলো'। শুরুতে কোক স্টুডিও বাংলা নামটি নিয়ে বির্তক থাকলেও আস্তে আস্তে প্রকাশিত গানগুলো পছন্দ করতে থাকেন শ্রোতারা।

কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কোকা কোলার প্রযোজনায় ভারত, পাকিস্তান বা আরো অনেক দেশের মতো ২০২২ সালের গোড়া থেকে বাংলাতেও এ ধরনের গান তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়। তবে গত বছর একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে বিতর্কের পর থেকে থমকে আছে কোক স্টুডিও বাংলার প্রযোজনা। এরপর আর আসেনি নতুন কোনো গান।

২০২২ সালে উদ্বোধনের পর প্রথম মৌসুমে কোক স্টুডিও বাংলার গান প্রকাশিত হয় মোট ১০টি। শায়ান চৌধুরী অর্ণব, বাপ্পা মজুমদার, সামিনা চৌধুরী, দিলশাদ নাহার কণা, পান্থ কানাই, ঋতুরাজ, মাশা, মিজান, নন্দিতা, রুবায়েত, বগা তালেব, অনিমেষ রায়, শেখ ইশতিয়াক, মমতাজ বেগম, তাহসান খান, সুনিধি নায়েকসহ আরও অনেক শিল্পীর অংশগ্রহণ ছিল ওই মৌসুমের গানগুলোয়।

প্রথম সিজনের সংগীত প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব। তার গানসহ ওই সময় বেশকিছু গান আলোচনায় আসে। গান প্রকাশ পাওয়ার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করতে দেখা যায় দর্শক শ্রোতাদের।

চট্টগ্রাম, সিলেট এবং খুলনার স্থানীয় ভাষায় গাওয়া গান 'মুড়ির টিন' দিয়ে শুরু হয় কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় মৌসুম। দেশের ছয়টি স্থানে বিশেষ স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে নতুন মৌসুমের প্রথম গানটি প্রকাশ করেন আয়োজকরা এবং তা জনপ্রিয় হয়।

দ্বিতীয় মৌসুমেও ১০টি নতুন গান প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় মৌসুমেও মিউজিক কিউরেটর ছিলেন শায়ান চৌধুরী অর্ণব। সংগীত প্রযোজক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন সংগীতশিল্পী প্রীতম হাসান, ফুয়াদ আল মুক্তাদির, ইমন চৌধুরী ও শুভ। দ্বিতীয় সিজনে প্রথম সিজনের কিছু শিল্পীর পাশাপাশি নতুন শিল্পীরাও অংশ নেন।

দ্বিতীয় মৌসুম শিল্পীরা হলেন রিয়াদ হাসান, তৌফিক আহমেদ, পল্লব, মেঘদল, নন্দিতা, ঈশান, প্রীতম হাসান, ফজলু মাঝি, ইসলাম উদ্দিন পালাকার, ঘাসফড়িং কয়ার, শিবলু মৃধা, আলেয়া বেগম, ইমন চৌধুরী, ফুয়াদ, মুর্শিদাবাদী, তাশফি, সুচনা, অর্ণব, সুনিধি, ফাইরুজ নাজিফা, অদিতি মোহসিন, বাপ্পা মজুমদার, হামিদা বানু ও আরও অনেকে।


২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হাসন রাজার 'দিলারাম' গান দিয়ে শেষ হয় কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় মৌসুম। দ্বিতীয় মৌসুমের পর দেশ ও দেশের বাইরের ১৮০ সুরকার ও শিল্পীদের অংশগ্রহণে ২০২৪ এর ১৩ এপ্রিল শুরু হয় তৃতীয় মৌসুমের প্রচার। বাংলা নববর্ষ ও ঈদ উপলক্ষে নতুন মৌসুমের যাত্রা হবে–– এমনটাই জানানো হয়।

যথারীতি এ মৌসুমে ১১টি গান প্রচারের কথা ছিল। তবে ১১টি গানের মধ্যে প্রকাশ পায় কেবল তিনটি গান। গত ১৩ এপ্রিল প্রকাশ পায় তৃতীয় সিজনের প্রথম গান 'তাঁতি'। এরপর ৩ মে আসে দ্বিতীয় গান 'মা লো মা'। সর্বশেষ গানটি প্রকাশ পায় ২৫ মে, ওয়ারফেজের 'অবাক ভালোবাসা', ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ব্যান্ডটি নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসে তাদের জনপ্রিয় গানটি।

তারপর থেকেই কার্যত থেমে আছে কোক স্টুডিও বাংলার কার্যক্রম। প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেলেও নেই নতুন গান প্রকাশের খবর। তৃতীয় মৌসুমীর ঘোষণা দেয়ার পরও কেন প্রকাশ পাচ্ছে না নতুন গান।

গত বছর ঈদুল আজহার আগে প্রচারে আসা কোকাকোলার একটি বিজ্ঞাপনের কারণেই থমকে গেছে কোক স্টুডিও বাংলার কার্যক্রম। বিজ্ঞাপনটি প্রচারে আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নেটিজেনদের 'রোষানলে' পড়েন বিজ্ঞাপনের নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা।

শুধু তাই নয়, ওই সময় কোক ব্রান্ডের সঙ্গে জড়িত সবকিছু বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। তাতে খানিকটা বিপদে পড়ে যায় ব্র্যান্ডটি। সেই অবস্থায় নতুন গান প্রকাশের ঝুঁকি নেননি আয়োজকরা।


যে বিজ্ঞাপন নিয়ে বিতর্কের শুরু, এতে দেখানো হয়— কোকাকোলাকে সবাই যে দেশের পণ্য মনে করছে, আসলে এটি সে দেশের পণ্য নয়। মানুষ সঠিক তথ্য না জেনেই কোকাকোলা বয়কটের ডাক দিয়েছে বলেও দাবি করা হয় এতে।

বিজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ১৯০টি দেশের মানুষ কোক খায়। এমনকি ফিলিস্তিনে কোকাকোলার ফ্যাক্টরি রয়েছে। মানুষকে বিভ্রান্ত না হয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে তথ্যগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় সমালোচনা। এমনকি ট্রলে শিকার হন এর অভিনয়শিল্পীরাও। তাদের বয়কটের হুমকি দেন অনেকে।

বিজ্ঞাপনটিতে মডেল হয়েছিলেন অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবন, শিমুল শর্মা, আব্দুল্লাহ আল সেন্টু প্রমুখ। অভিনয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনটি নির্মাণের পেছনেও ছিলেন শরাফ আহমেদ জীবন। তবে বির্তক শুরু হলে জীবন নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি লেখেন, কাজটি তার পেশাগত জীবনের একটি অংশমাত্র। তিনি সবসময় ন্যায়ের পক্ষে এবং মানবতার পাশে আছেন। বিতর্ক শুধু এই বিজ্ঞাপন নিয়েই হয়নি।

তৃতীয় মৌসুমের 'মালো মা' গানটির গীতিকার ক্রেডিট দেয়া নিয়েও বির্তক শুরু হয় গানটি প্রকাশের পর। নেত্রকোনার বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের 'মাগো মা' গানের সঙ্গে ঢাকার সাধক, কবি ও শিল্পী খালেক মা' গানের মিল খুঁজেছেন শ্রোতারা।

তবে বিতর্ক-সমালোচনা ছাপিয়ে কোক স্টুডিও যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ এর দর্শকশ্রোতা। কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় চার মিলিয়ন সাবস্ক্রাইকবার, ভিউ ছাড়িয়েছে ৬০০ মিলিয়ন। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। পুরনো গানগুলোই শুনছেন শ্রোতারা।


বিজ্ঞাপন নিয়ে সমালোচনার সূত্র ধরে কোক স্টুডিও বাংলার নতুন গান নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। প্রথম সিজনের 'বুলবুলি' গানের গায়ক ঋতুরাজের ফেসবুক পোস্টেও সেই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ফেসবুকে ঋতুরাজ কিছুদিন আগে লিখেছিলেন, "একটা অ্যাড বানানোর জন্য গানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কেন?"

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোক স্টুডিও বাংলার সংগীত প্রযোজক ও সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব বলেন, "কোক নিয়ে সারা দেশে ও বিশ্বে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়েছিল। ইসরায়েল-ফিলিস্থিনি যুদ্ধের কারণে কোক বয়কট করার প্রচারণা চলছিল। এই অবস্থায় তো আসলে গান প্রকাশ করা যায় না।"

"শুধু গান প্রকাশ নয়, আমাদের কনসার্টও করার কথা ছিল। কিন্তু শেষমেষ সেটা আর করা যায়নি," বলেন অর্ণব। তবে কোক স্টুডিও সংশ্লিষ্টরা এটাও বলছেন, গান প্রকাশের বেলায় জুলাই-অগাস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও বিবেচনা রাখা হয়েছে।

অর্ণব বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে কোক স্টুডিও বাংলার গান প্রকাশ থেমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। তবে এটি ঠিক দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকেই তারা মাথায় রেখেছেন।

তবে গান প্রকাশ নিয়ে কোক এর ক্রিয়েটিভ সল্যুশন কোম্পানি ডটবার্থ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন বলেন, "নেতিবাচক প্রচারণার জন্যই বিরতি নেয়া হয়েছে। তবে অবস্থা ভালো হলে দু এক মাসের মধ্যেই নতুন করে ঘোষণা আসবে।"


কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় মৌসুমের ভিজ্যুয়াল আউটপুট পরিচালনা করেছেন ডোপ প্রোডাকশন-এর কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং রানআউট ফিল্মস-এর আদনান আল রাজীব। নতুন গান আসা প্রসঙ্গে রাজীব বলেন, 'নতুন গান কবে নাগাদ প্রকাশ পাবে সে বিষয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারছি না। এসব নিয়ে পুরো সিদ্ধান্ত কোক ও সংশ্লিষ্ট এজেন্সি নিয়ে থাকেন।'

তৃতীয় সিজনের গান মোটামুটি প্রস্তুত আছে বলে জানান তিনি। তবে অন্য একটি সুত্র থেকে জানা গেছে প্রস্তুত রাখা গানগুলোর মধ্যে খ্যাতিমান শিল্পী রুনা লায়লার গানও রয়েছে। আছে হাবিব ওয়াহিদের গানও।

নতুন গান নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন অর্ণব। বলেন, 'খুব দ্রুত আমাদের আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কবে নাগাদ নতুন গান প্রকাশ করা যায়। এটা এই বছরের মাঝামাঝিও হতে পারে।'

সূত্র: বিবিসি

শহীদ

×