![দর্শককে কাছে টানছে ‘পাখিদের বিধানসভা’ দর্শককে কাছে টানছে ‘পাখিদের বিধানসভা’](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/16-2502091830.jpg)
.
বর্তমানে প্রতি মাসেই ঢাকার নাট্যমঞ্চে নতুন নাটকের সন্ধান মেলে। কোনো মাসে আবার একাধিক নতুন প্রযোজনাও মঞ্চস্থ হয়। তাই বলে সব নাটক দর্শককে কাছে টানে না। ফলশ্রুতিতে দর্শকখরায় মিলনায়তনের অধিকাংশ আসন খালি থাকে। উল্টোদিকে মানসম্পন্ন নাটক হলে সহজাতভাবেই নাট্যপ্রেমীরা হাজির হয় মঞ্চে। অন্তর্গত বিষয়, সুনিপুণ নির্দেশনা, যথার্থ আলোক পরিকল্পনা কিংবা মঞ্চসজ্জা, সর্বোপরি মঞ্চশিল্পীদের কুশলী অভিনয়সহ বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের সম্মিলনে একটি নাটক হয়ে ওঠে দর্শকপ্রিয়। সম্প্রতি মঞ্চে এসেছে তেমনই এক নাটক ‘পাখিদের বিধানসভা’। প্রযোজনাটির টানা পাঁচ প্রদর্শনী নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে চলছে নাট্যোৎসব। রবিবার সন্ধ্যায় নাটকটির চতুর্থ মঞ্চায়ন হয়। বাকি তিনটি প্রদর্শনীর মতো এদিনও মিলনায়তনে বিরাজ করেছে নাট্যপ্রেমীদের সরবতা। আজ সোমবার সন্ধ্যায় পঞ্চম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।
সুফি জীবন দর্শনের গল্পময় প্রযোজনাটি মঞ্চে এনেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ। নাটকটি লিখেছেন ওই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহমান রহমান মৈশান। পরিকল্পনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের অংশ হিসেবে বিভাগের ১৪ জন শিক্ষার্থী অভিনয় করেছেন এই নাটকে। ইরানের প্রখ্যাত সুফি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তার রচিত ধ্রুপদী কবিতা ‘মানতিকুত তোয়ায়ের’ অবলম্বনে রচিত প্রযোজনাটির গবেষণা ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক সুফি দর্শন গবেষণা কেন্দ্র দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
প্রযোজনাটির দর্শকপ্রিয়তা প্রসঙ্গে নির্দেশক আহমেদুল কবির বলেন, নাটকের মাঝে মানুষ জীবনের সত্যকে সন্ধান করে। এই নাটকের কাহিনীতে দর্শকের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে। ঘটনাপ্রবাহে শান্তি ও সম্প্রীতির পাশাপাশি আত্মদর্শনের কথা উঠে এসেছে। মানুষ হিসেবে আপন সত্তাকে খুঁজে ফেরার বিষয়টি শিল্পিত পথরেখায় উপস্থাপিত হয়েছে। এই কাহিনীর সঙ্গে মঞ্চশিল্পীদের সপ্রতিভ অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, সংগীত ও আলোক পরিকল্পনার সঙ্গে যথার্থ নির্দেশনার গুণে নাটকটি নাট্যপ্রেমীদের কাছে ভালো লেগেছে। তাদের কাছে টেনেছে।
নাটকটির গল্পের গহীনে রয়েছে রূপক আশ্রয়ী সুফিতত্ত্ব। সেই সুবাদে নাটকের পাখিগুলো হলো সাংকেতিক চরিত্র। নাটকের দর্শন পরিসরেও রূপক-সংকেতের সংযোগ ঘটেছে। নাটকের চরিত্র ধারণকারী অভিনয়শিল্পীরা সকলেই পাখি, মন-পাখি, প্রাণ-পাখি কিংবা রূহ-বিহঙ্গ। তাই প্রত্যেকটি চরিত্রই পাখিদের মুভমেন্টকে ফুটিয়ে তুলেছে। আর পাখি হলো প্রতীকী ধারণা; যা কিনা দেহলীন চিরন্তন আত্মার প্রতীক। নিউ নিবারাল বুর্জোয়া জীবন ব্যবস্থায় বক্তির বিচ্ছিন্নতাবোধ পেরিয়ে পাখিরূপী মানুষের আত্মানুসন্ধানের এক মহাজাগতিক পরিভ্রমণের রূপক হিসেবে সৃজিত হয়েছে পাখিদের বিধানসভা। ব্যক্তিবাদী ভোগ, উপভোগের মিথ্যা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তুতন্ত্র গুঁড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসা ও জানের সংশ্লেষে গঠিত ‘সত্য’ সন্ধানের মাধ্যমে যৌথ জীবনের কথা বলে এই নাটক। একইসঙ্গে আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের সম্ভাবনাকেও নিরীক্ষণ করেছে প্রযোজনাটি। একাকিত্ববাদী জীবনের উল্টোপিঠে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে সূচিত সম্মিলিত এক জীবনযাত্রার গল্প উঠে এসেছে কাহিনীতে। প্রেম ও জ্ঞানের ভেতর দিয়ে সামষ্টিক জীবনের সত্যকে সন্ধান করে প্রযোজনাটির ঘটনাপ্রবাহ। ধারণ করেছে জীবনের পরম সার্থকতাকে।
প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে নাট্যকার শাহমান রহমান মৈশান বলেন, এই নাটক বস্তুত ধ্রুপদী সুফি সাহিত্যের সঙ্গে আমার সময়ের ঘনিষ্ঠতা সন্ধানের একটি নান্দনিক-রাজনৈতিক পদ্ধতির ফলিত রূপ। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের আগুন লাল সময়ের জঠরে বাস করে লিখেছি ‘পাখিদের বিধানসভা’। ফলে এই নাটক হয়ে উঠেছে এই সময়ের সম্মিলিত রুহের শিহরণ-কম্পিত আধ্যাত্মিকতার এক রাজনৈতিক নাটলিপি। আত্তারের কবিতা যদি হয় আধ্যাত্মিক মুক্তির ধর্মতত্ত্বীয় তরিকা, তবে আমার নাটক হলো আত্মসত্ত্বার রাজনৈতিক রূপান্তরের নন্দন ভাষ্য।
প্রযোজনাটির মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনা করেছেন মহসিনা আক্তার। আলোক পরিকল্পনা করেছেন ধীমান চন্দ্র বর্মণ। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন ড. সাইদুর রহমান লিপন। রূপসজ্জা পরিকল্পনা করেছেন শুভাশীষ দত্ত তন্ময়।