ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

সুন্দরের প্রতিচ্ছবিময় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলনের সমাপ্তি

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

সুন্দরের প্রতিচ্ছবিময় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলনের সমাপ্তি

ছায়ানট মিলনায়তনে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন

টানা তিনদিন ধরে গান শোনালেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তের কয়েকশ শিল্পী। উদীয়মান থেকে প্রখ্যাত শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের সেই সুর নির্যাসে আলোড়িত হয়েছে শ্রোতার হৃদয়। কবিগুরুর সৃষ্টি¯œাত প্রকৃতি, প্রেম, পূজা কিংবা স্বদেশ পর্যায়ের গানে-গানে খুঁজে নিয়েছেন প্রশান্তির অনুভব।

গানের সঙ্গে আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে আবৃত্তি, পাঠ, নৃত্য ও গীতিআলেখ্যর পরিবেশনা। সুন্দরের প্রতিচ্ছবিময় সেই জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ৪৩তম বার্ষিক অধিবেশনের শেষ দিন ছিল শনিবার। সমাপনী দিনে সংগীত পরিবেশনার সমান্তরালে প্রদান করা হয় রবীন্দ্র পদক। আবহমান বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ও মুক্তচিন্তার সমাজ গঠনের প্রত্যাশায় পাঠ করা হয় ঘোষণাপত্র। সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে।
শীতল সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের সমাপনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। বুলবুল ইসলামের  নেতৃত্বে সারাদেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন। এরপর ছায়ানট মিলনায়তনে প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মফিদুল হকের সভাপতিত্বে আর্থিক প্রতিবেদন পেশ করেন পরিষদের কোষাধ্যক্ষ নাসেহুন আমীন।

প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা। সারাদেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেন। বিকেলে প্রধান অতিথি ছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জহিরুল হক খান। অধিবেশনের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন লাইসা আহমদ লিসা। রবীন্দ্র পদক ও গুণী সম্মাননা প্রদান করা হয় প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে। শিল্পীর পক্ষ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার স্বামী সারোয়ার ই আলম। 
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, গত বছরের আলোড়নময় ঘটনাবলির পটভূমিতে বর্তমান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা জুলাই- আগস্টের উত্তাল সময়ে বিপুল প্রাণহানির জন্য গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সকল হত্যার নিরপেক্ষ সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। আমরা জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের বিগত তিনটি সম্মেলনের  ঘোষণায় সর্বগ্রাসী লোভের বিস্তারের ফলে সামাজিক অবক্ষয় এবং ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম।

বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাত সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। তবে, উল্লিখিত নেতিবাচক প্রবণতাসমূহ প্রভাবশালী মহলের দ্বারা পরিপুষ্ট হওয়ার বিভিন্ন ইঙ্গিত লক্ষ্য করে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর লালন, রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙচুর অশনি সংকেত বহন করে।

এই শঙ্কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত জাতীয় সংগীত পরিবর্তন, জাতিসত্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে অনভিপ্রেত কৌশলী প্রস্তাবনা। তাই আমাদের প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার নির্বিঘ্ন পথযাত্রা নিশ্চিত হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়,  প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আয়োজন তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে, আপন সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জাতি পরিচয়ের প্রধান নির্ধারক। জাতীয় সংস্কৃতি স্বাভাবিক গতিতে চলমান থাকে, বহিঃস্থ উপাদান গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।

এক্ষেত্রে, সম্মিলন পরিষদ সকলের স্মরণে আনতে চায়, ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকেরা উভয় অঞ্চলের জাতিসত্তার মানুষকে  কেবল ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে চিহ্নিত করার জন্য আঘাত হানে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রসংগীতকে তথ্যমাধ্যমে নিষিদ্ধ করে, নজরুলসংগীত খ-িত রূপে প্রচারিত হয়।

তাই জাতিগত বৈষম্যের শিকার বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রামের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ ছিল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। রাষ্ট্রীয় বাধার মুখে রবীন্দ্রনাথসহ বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারদের গান, নাটক হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। সকলকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের এই মৌলিক বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

বিশ্বকবির সৃষ্টির আলোকে মানবিক সমাজ বিনির্মাণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা জানিয়ে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের বাঙালির প্রাণের সম্পদ। পূর্ববাংলায় অবস্থানকালে তিনি পদ্মা পাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। এই প্রথম তিনি সাধারণ পল্লি জীবন ও দরিদ্র অসহায় মানুষ, বিশেষত মুসলিম কৃষক সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। এ সময় তিনি কেবল কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচনা করেননি; কর্মী রবীন্দ্রনাথ সমবায়, শিক্ষা বিস্তার ও পল্লি উন্নয়নে নিজেকে নিবেদন করেছেন।

পূর্ববাংলার প্রকৃতি বন্দনা নিয়ে বাউল সুরে গীত আমাদের জাতীয় সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে শিলাইদহে। অন্যদিকে পারিবারিকভাবে একেশ্বরবাদী রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় আচার-সর্বস্বতা ত্যাগ করে  হিন্দু মুসলমানকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন, সংঘাতময় বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রাণিত করেছেন। আজ যখন স্বদেশে মতাদর্শগত কারণে বিভাজিত সমাজের সাংঘর্ষিক রূপ পরিলক্ষিত হয়, বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় সংস্কৃতির সুরক্ষা জটিল হয়ে পড়ে, ফিলিস্তিনে শিশুহত্যা চলে, তখন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম আমাদের বিশ্বশান্তি এবং দেশে সহিষ্ণু উদার মানবিক সমাজ গড়তে অনুপ্রাণিত করে।

সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন খন্দকার খায়রুজ্জামান কাইয়ুম, মনসুরা  বেগম. মেজবাহুল আলম, সুমা রায়, প্রকৃতি রায় সাঁঝ, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, তাজমিনুর রহমান, রানা সিন্হা, আব্দুলাহ আল মামুন, সিরাজুল সালেকীন, শম্পা আচার্য, বুলবুল ইসলাম, এ টি এম জাহাঙ্গীর, লাইসা আহমদ লিসা, তানিয়া মান্নান, বিথী পা-ে, ঝুমা খন্দকার, পূরবী দে  সেমন্তী, মৃদুল চক্রবর্তী, নুরজাহান বেগম শ্যামলীনা, মহাদেব ঘোষ, দিবাকর বিশ্বাস, শিমু দে, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, আজিজুর রহমান তুহিন ও শামা জয়নাব। লোকসংগীত পরিবেশন করেন চন্দনা মজুমদার, শ্রীকৃষ্ণ গোপাল ও সাগর বাউল। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সিলেটের নৃত্যশৈলী। একক নৃত্য পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী, সুইটি দাশ ও তাথৈ।

×