হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় লোকসংগীত আলকাপ গান
‘আলকাপ’ মূলত অবিভক্ত বঙ্গদেশের লোকসংগীত। অবিভক্ত মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব এ লোকসংগীতের চর্চা ও ধারাবাহিকতা বীরভূম, মালদহ ও বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও বৃহত্তর রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে চর্চিত ও প্রবহমান। তবে আকাশ সংস্কৃতি এই সময়ে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের জনপ্রিয় এই লোকসংগীত।
আলকাপ গান পালা গানেরই একটি অংশ। কবি গানের আদলেই গাওয়া হয় এই গান। যার প্রধান উপজীব্য ছড়া ও গান। আলকাপ গানের উল্লেখযোগ্য দিক হলোÑ লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাসহ নানান ধরনের বিষয় এই গানে ফুটে উঠতে দেখা যায়। তবে রাধাকৃষ্ণের কথা আলকাপ গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।
গ্রাম্য জীবনের সহজ সরলতা গানের সহজ বিশেষত্ব। মুসলমান সমাজের বিশাল অংশের মধ্যে এই গান আদৃত হলেও আধুনিক সংস্কৃতির চাপে ধীরে ধীরে এর প্রচলন কমতে থাকে।
গতানুগতিক গানের চাইতে আলকাপ গান একটু ভিন্ন ধারার। গানের দলের প্রধানকে সরকার বা মাস্টার বা মোড়ল বলা হয়। তার সঙ্গে থাকেন একজন ভাঁড়, যাকে আলকাপের ভাষায় ‘কাপ্যাল’ বলা হয়। এ ছাড়া গানের দলের ছোকরা, ছুকরিরা অভিনয় করেন। দলে থাকেন কয়েকজন বাদক। তারা ঢোলক, হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলা, খঞ্জনি, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন।
তবে আধুনিক সংস্কৃতির প্রভাবে আলকাপ গানের শিল্পীদের জীবন এখন দুর্বিপাকে ঘেরা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং অর্থাভাবে শিল্পীরা গানের চর্চা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছেন না। অনুশীলনের জন্য ক্লাব না থাকা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও ধারাবাহিকভাবে গান মঞ্চায়নের সুযোগ না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে এককালের জনপ্রিয় এই গান। শৈশব থেকেই আলকাপ গানের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার ‘আলকাপ রঙ্গরস গ্রাম থিয়েটার’ এর মাস্টার আলতাফ হোসেন। বললেন, ‘বাল্যকাল থেকেই আলকাপ গান করি। আগে পাড়া মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জে এই গানের আসর বসত।
একসময় বিভিন্ন স্থানে এই গানে অংশ নিয়েছি। কিন্তু ধীরে ধীরে এই গান হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অর্থাভাবে দলকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছি। দলের সদস্যদের ঠিকমতো পয়সা-কড়ি দিতে পারি না। দলের সদস্যদের কথা শুনিয়ে, সান্ত¦না দিয়ে বহু কষ্টে দলকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। যে আয় হয় তা দিয়ে খরচ বহন করা কষ্টকর। সামান্য কিছু আয় দিয়ে পরিবারের পাশাপাশি দল চালানো অসম্ভব। ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। ধারাবাহিকভাবে লোকনাট্য মঞ্চায়নের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হোক।
দলের অন্য সদস্যরাও না পাওয়ার বেদনা নিয়ে বললেন, অনুশীলনের জায়গা নেই, ভালো বাদ্যযন্ত্র নেই। দলের প্রায় সবার মন মরে গেছে। কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায় না। আমরা পুরনো দিনের এই বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাই। এজন্য সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পাই।
এক সময় গ্রামীণ যে কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষকে আয়োজন করা হতো আলকাপ গানের আসর। রাতভর চলা সেই গান মুগ্ধ হয়ে শোনতেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই। এই গানের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংগীতপ্রেমীরা।