.
জীবন ও সংস্কৃতির সমন্বিত বহমান এক শিল্পধারা প্রাচ্য-চিত্রকলা। সেই সুবাদে এই ধারার ক্যানভাসে মূর্ত হয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষের কৃষ্টি, সংস্কৃতি থেকে জীবনধারা। রং-তুলির আঁচড়ে চিত্রপটে ধরা দেয় লোকজ ঐতিহ্য থেকে দরবারি আভিজাত্য। শুধু কি তাই! নারীর সৌন্দর্য থেকে নিসর্গের নান্দনিকতা মেলে ধরতেও জুড়ি নেই শিল্পমাধ্যমটির। তেমনটাই চোাখে পড়ে প্রগতি সরণির অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে। এখানে চলছে শান্তি ও সম্প্রীতির সন্ধান শীর্ষক দশম প্রাচ্য-চিত্রকলা প্রদর্শনী। যৌথ এই শিল্পায়োজনের আয়োজক অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস এবং ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রপ (ওপিএসজি)।
নবীন থেকে উদীয়মান, প্রবীণ থেকে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্মে সেজেছে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তাবহ এই প্রদর্শনী। জলরং, তেলরং, অ্যাক্রেলিক, টেম্পারাসহ নানা মাধ্যমের আশ্রয়ে চিত্রিত হয়েছে চিত্রকর্মসমূহ। প্রতিটি কাজে রয়েছে যতেœর ছোঁয়া। সেই সূত্রে শিল্পরসিককে সহজেই কাছে টেনে নেয় ছবিগুলো। নয়নে ছড়িয়ে দেয় প্রশান্তির পরশ। ভালোলাগার অনুভব ছুঁয়ে যায় মননে। সেই বাস্তবতায় ড্রইংয়ের অনন্য উদাহরণ মেলে চিত্রকর মূর্তজা বশীরের ক্যানভাসে। পথিকৃৎ এই শিল্পীর কাজে নেই কোনো রঙের বাহুল্য। অল্প কিছু রেখার টানে চমৎকারভাবে দৃশ্যমান হয়েছে এক নারীর অবয়ব। সুদূর পানে চেয়ে থাকা ওই রমণীর চোখ যেন বলে যায় না বলা অনেক কথা। জলরঙের আশ্রয়ে বিস্তৃত চিত্রপটে সখীদের দ্বারা বেষ্টিত পৌরাণিক চরিত্র শকুন্তলার ছবি এঁকেছেন মলয় বালা। সুখময়তা ও আনন্দের গল্প বলে যায় এই ক্যানভাস। উড়ন্ত পাখির সঙ্গে লতাপাতার সম্মিলনে বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো তিন নারীর ছবি এঁকেছেন মো. মুসলিম মিয়া। হামিদুজ্জামান খানের জলরঙের ক্যানভাসে মূর্ত হয়েছে সবুজ শ্যামলে শোভাময় বাংলাদেশ। প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধির কথা জানান দেয় শম্ভু আচার্যের চিত্রপটে ঠাঁই পাওয়া চাঁদ সওদাগরের গল্পগাথা। বাংলার লোকসাহিত্যকে উপজীব্য করে ক্যানভাস রাঙিয়েছেন প্রখ্যাত শিল্পী আব্দুস শাকুর শাহ। শান্তির প্রতিচ্ছবিময় মাতৃত্বের ছবি এঁকেছেন আফরোজা জামিল কংকা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের সৌম্যকান্তি রূপটি মেলে ধরেছে আব্দুস সাত্তারের ক্যানভাস। আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় সূচিশিল্পী আমিনুল ইসলামের নকশি কাঁথার কাজে। বৃক্ষতলে দুই নারীর নিমগ্ন সংগীতচর্চার মাঝে শান্তির সন্ধান করেছেন বদরুজ্জামান খান। জলরঙে আঁকা ছবিটির শিরোনাম সংগীতের শান্তি। মিশ্র মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কর্মময় জীবন সংগ্রামের দৃশ্যকল্প মেলে ধরেছে দেবাশীষ বিশ্বাসের চিত্রপট। এক কথায় প্রদর্শনীর প্রতিটি কাজেই রয়েছে শিল্পের সহজবোধ্যতার সঙ্গে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য।
শনিবার শীতল বিকেলে এই শিল্পায়োজনের সূচনা হয়। একইসঙ্গে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান চারুশিক্ষার্থীদের কাজের মধ্য থেকে নির্বাচিত পাঁচটি শিল্পকর্মের শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হয়। এ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী মনিরুল ইসলাম, বিশিষ্ট শিল্পী সমর মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম শেখ, হারস্টোরি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জেরিন মাহমুদ হোসেন ও ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রুপের প্র্রধান উপদেষ্টা মিখাইল ইদ্রিস ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের চেয়ারপারসন নীলু রওশন মুর্শেদ।
বৈচিত্র্যময় এই প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি ছবিতে রয়েছে যতেœর ছোঁয়া। অংশগ্রহণকারী সকল শিল্পীই শিল্প সৃজনে স্বতন্ত্র পথ খুঁজে নিয়েছেন। এ কারণেই প্রদর্শনীর ছবিগুলো মনোটোনাস বা একঘেয়ে লাগে না। বরং সময় নিয়ে ছবিগুলো দেখতে ভালো লাগে।
পুরস্কারজয়ী উদীয়মান পাঁচ নবীন শিল্পী হলেন সৌরভ ঘোষ, শাহানুর মামুন, হাসুরা আক্তার রুমকি, মো. বাদশ হারুন-নূর রশিদ ও নাজমুল হক বাপ্পী। তাদেরকে সম্মাননা স্মারক ও পুরস্কারের অর্থমূল্য তুলে দেন অতিথিরা। উন্মুক্ত আহ্বানের মাধ্যমে জামা পরা কয়েকশত শিল্পকর্ম থেকে নির্বাচন কমিটির মাধ্যমে শিল্পীদের কাজ নির্বাচন করা হয়েছে। তাদের কাজে বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য, দরবারি আভিজাত্য এবং আধুনিক প্রাচ্যচিত্রের বহুমাত্রিক রূপের সমাহার ঘটেছে। মোট ৫৪ শিল্পীর শিল্পের সমাহাজারে সেজেছে এই শিল্পায়োজন। খ্যাতিমান শিল্পীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষানবিশ তরুণ শিল্পীসহ গুণী লোকশিল্পীদের শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে।
আগামী ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।