ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনিময় কনসার্ট

রাহাত ফতেহ আলীর গানে শ্রোতার অপার মুগ্ধতা

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:০৬, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

রাহাত ফতেহ আলীর গানে শ্রোতার অপার মুগ্ধতা

পাকিস্তানি কণ্ঠশিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খান।

রাজধানীর গানপ্রেমীদের জন্য দিনটি ছিল দারুণ আনন্দের। বিচিত্রি সুরের অবগাহনে   কেটে গেছে তাদের দুরন্ত সময়।  সুরেলা  সেই সফরের শুরুটা হয় বিকেলে। শ্রোতাদের মুগ্ধতার আবেশে ভাসানো সংগীতাসরটির সমাপ্তি হয় রাত এগারোটার পর। মাঝে কয়েক ঘন্টার সুরের  শ্রোতধারায় আবিষ্ট হলো মন-প্রাণ।

সেই মুগ্ধতার অনুভবে কখনো বা শিল্পীর কণ্ঠের সমান্তরালে সুর মিলিয়েছেন। আবার কখনো উচ্ছ্বাসে জমিন থেকে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে নেচেছেন গানের তালে। এই গানের আসরে পরিবেশিত হয়েছে নানা ধারার গান। সেই সুবাদে বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী কনসার্টটিতে শ্রোতারা শুনতে পেয়েছেন দেশীয় ব্যান্ডসংগীতের সঙ্গে র‌্যাপ গায়কদের মনমাতানো গান।  সেই সঙ্গে  শোনা হয়েছে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীতধারা কাওয়ালি থেকে বলিউডের সিনেমার গান।

শনিবার আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই কনসার্টের শিরোনাম ছিল ‘ইকোস অব   রেভল্যুশন’।  জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তার জন্য এই চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন করে ‘স্পিরিটস অব জুলাই’ নামের প্লাটফর্ম। অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনিময় এ কনসার্ট থেকে আয়কৃত অর্থ শহীদ জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে অনুদান  দেওয়া হবে।


মানবতার সেবায় নিবেদিত এ কনসাটের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন সুফিগানের কিংবদন্তি পাকিস্তানি কণ্ঠশিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খান। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি অংশ নিয়েছেন এই সংগীতায়োজনে।  এই শিল্পী যতক্ষণ গান গেয়েছেন  তন্ময় হয়েছে শুনেছেন গানপ্রেমীরা। রাহাতের কণ্ঠের খেলায় কখনো বা উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হয়ে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়েছেন শরীর। রাত নয়টা ৫০ মিনিটে মঞ্চে আসেন এই শিল্পী। মঞ্চে উঠেই  সবাইকে সালাম দিয়ে  নিজের পরিচয় দিলেন ছোট করে। জানালেন সঙ্গে তার ছেলেও প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছে।

পরিবারের ৫০০ বছরের সঙ্গীত পরম্পরার ঐতিহ্য ধারণকারী শিল্পী গাইলেন  গলা ছেড়ে। শুরুতেই কণ্ঠে তুলে নেন বলিউড মুভির গান ‘তুনা জানে আসপাস হ্যায় খুদা’।  এরপর পরিবেশন করেন চাচা নুসরাত ফতেহ আলীর গান ‘সাজনা তেরে বিনা’।  পাঞ্জাবি ভাষার এই গানেই মজালেন সুররসিকদের। বৈঠকী ঢংয়ে যখন তিনি ‘ও রে পিয়া’ গেয়েছেন তখন  শ্রোতারাও কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন সেই সুর। সম্মিলিত সেই সুরধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে  আর্মি স্টেডিয়ামের বিশাল প্রান্তরজুড়ে। ভালোলাগার অনুভবে ঝরেছে মুর্হুমুর্হু করতালি।

ছড়িয়েছে কলরব। পঞ্চম পরিবেশনায় তিনি গেয়েছেন প্রেম ও ভক্তিমূলক কাওয়ালি গান ‘জরুরি থা’। এরপর শুনিয়েছেন  মেরে রসকে কামার তুনে পেহেলি নজর/জব নজর ছে মিলায়ি মাজা আগায়া/জোস হি  জোস  মে মেরী আগোশ  মে/আকে তু জো ছামায়ী মাজা আগায়া ...।  এরপর ‘আফরিন আফরিন’সহ  নানা আঙ্গিকের গানে গানে ঘণ্টারও বেশি পরিবেশনা পর্বে মাতিয়ে রেখেছেন শ্রোতাদের।  


এর আগে রাত  সাড়ে  নয়টায় মঞ্চ থেকে ঘোষণা এলো এবার আসছেন ওস্তাদ রাহাত ফতেহ আলী খান।  ঘোষণাটি দেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। এসময় মঞ্চে উপস্থিত আরেক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ফরিদা আখতার বলেন, এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। খুনী হাসিনার বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে। তরুণরা  স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে।  আসিফ মাহমুদ বলেন, ২০২১ সালে টিএসসিতে  আমরা বন্ধুরা মিলে কাওয়ালি গানের আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু সেটা ছাত্রলীগের বাধায় প- হয়ে  যায়। এবার কাওয়ালির কিংবদন্তি বাংলাদেশে গাইছেন। বাংলাদেশের মানুষ যে স্বপ্নের দেশ চায় সেই বাংলাদেশ গড়বো আমরা।


রাহাত ফতেহ আলীকে অনুসরণ করে দেশের শিল্পীরাও স্বল্প পারিশ্রমিকে অংশ নিয়েছেন এই কনসার্টে। শ্রোতাদের মনমাতানো এই আয়োজনে অংশ নেয়  দেশীয় ব্যান্ডদল আর্টসেল, চিরকুট, অ্যাশেজ ও আফটারম্যাথ। এছাড়া সংগীত পরিবেশন করেন র‌্যাপ গায়ক  সেজান ও হান্নান। গান ছাড়াও জুলাই বিপ্লব-সংক্রান্ত গ্রাফিতি প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক ও মুগ্ধ ওয়াটার  জোন কনসার্টে যুক্ত করে ভিন্ন মাত্রা।


দুপুর ২টায় দর্শকদের জন্য কনসার্টের ফটক খুলে  দেওয়া হয়। এসময়  জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম ঘোষণা দেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত ১০০ জন কনসার্টের ভিআইপি আসনে সামনের সারিতে থাকবেন। রাত আটটার আগে ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধসহ জুলাই আন্দোলনে আহতদের নিয়ে আবারো মঞ্চে আসেন সারজিস আলম। এসময় স্নিগ্ধ সবাইকে নিয়ে ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ/শেষ হয়নি যুদ্ধ’ বলে  স্লোাগান দেন। এসময় জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনাকে খুনি আখ্যা দিয়ে তার বিচার দাবি করেন। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করার দাবিও জানানো হয়।


পরিবেশনা পর্বের শুরুতে মঞ্চ মাতিয়েছেন আলোচিত দুই  র‌্যাপার সেজান ও হান্নান৷ হান্নান শুনিয়েছেন অভ্যুত্থানের উদ্দীপনামূল সেই গান ‘আওয়াজ উডা’। এই গানটি গাওয়ার কারণে অভ্যুথানের সময় জেল খেটেছিলেন হান্নান। সেজান শুনিয়েছেন  ‘কথা ক’ শীর্ষক সংগীত।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাওয়ালি গানের দল সিলসিলার পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় কনসার্ট।  ব্যান্ডদল আফটারম্যাথ পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল  ‘হুংকার’,  ‘ধোয়া ও ‘উৎসর্গ’। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ শীর্ষক গান দিয়ে পরিবেশনা শুরু করে চিরকুট৷ এরপর ব্যান্ডদলটি একে একে গেয়ে  শোনায় ‘জাদুর শহর’, ‘মরে যাবো’, ‘আহারে জীবন’ ‘কানামাছি'সহ বেশ কিছু গান।


প্রসঙ্গত, বর্তমানে কাওয়ালি আর সুফিগানে দুনিয়ার  সেরা শিল্পী ধরা হয় রাহাত ফতেহ আলী খানকে। এই শিল্পীর পরিবারের রয়েছে ৫০০ বছরের কাওয়ালি চর্চার ঐতিহ্য। রাহাত ফতেহ আলী খানের বাবা ওস্তাদ ফররুখ ফতেহ আলী খান, দাদা ফতেহ আলী খান, চাচা নুসরাত ফতেহ আলী খান। প্রত্যেকেই কালের সেরা শিল্পী। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে রাহাত তার চাচা ও বাবার সঙ্গে গাওয়া শুরু করেন। সর্বশেষ চাচা নুসরাত ফতেহ আলী খানের ছায়া থেকে বেরিয়ে তৈরি করেছেন নিজের আলাদা পরিচয়। সংগীতের ওপর অগাধ দখল ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রাহাত ফতেহ আলী খানকে দিয়েছে ‘ডক্টরেট অব মিউজিক’ এর বিশেষ সম্মাননা। তাকে মুসলিম সুফিদের ভক্তিমূলক গান ও কাওয়ালির কিংবদন্তি হিসেবেও অভিহিত করেছে অক্সফোর্ড।


১৯৯৭ সালে মাত্র ওস্তাাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান মারা যাওয়ার পর অল্প সময়েই কাওয়ালি আর সুফিগানের শিল্পী হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পান। দুনিয়াজুড়ে রয়েছে তাঁর গানের অসংখ্য শ্রোতা আর ভক্ত।

মনোয়ার/ রিয়াদ

×