ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের বার্ষিক প্রদর্শনীর ছবি দেখছেন দর্শনার্থীরা
আধুনিক শিল্পচর্চার জনপ্রিয় এক মাধ্যম গ্রাফিক ডিজাইন। মানুষের নিত্যদিনের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে চারুশিল্পের এই মাধ্যমটি। চায়ের কাপের নকশা থেকে চানাচুরের প্যাকেটের সুদৃশ্য মোড়কÑএমন সবকিছুতেই রয়েছে গ্রাফিক ডিজাইনের ছোঁয়া। শুধু কি তাই! শিল্পমাধ্যমটির যথার্থ প্রয়োগে পোশাক থেকে বইয়ের অঙ্গসজ্জা হয়ে ওঠে নান্দনিক। আর এই শিল্পমাধ্যমটির ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধনে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ। এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের সারা বছরের কাজ থেকে বাছাইকৃত শিল্পকর্ম নিয়ে শুরু হলো বৈচিত্র্যময় বার্ষিক প্রদর্শনী। সোমবার সন্ধ্যায় অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে এই প্রদর্শনীর সূচনা হয়।
গ্রাফিক ডিজাইনের সমান্তরালে নানা মাধ্যমে কাজের সম্মিলন ঘটেছে এই শিল্পায়োজনে। সেই সুবাদে ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে দেখা মেলে জলরং, তেলরং, অ্যাক্রেলিক, পেন্সিল, কালি ও কলমসহ নানা মাধ্যমে সৃজিত শিল্পকর্ম। সেসব কাজে দৃশ্যমান হয়েছে চারপাশের চেনা জগতের নানা বিষয়। চিত্রপটে ধরা দিয়েছে গ্রামীণ জীবন থেকে নগরায়নের দৃশ্যকল্প। রয়েছে স্টিল লাইফের ছবি। আছে ফিগার ড্রইং। জলরং আশ্রিত তেমনই এক ছবিতে নিবিড় মনোযোগে বাঁশের ফালি জোড়া দিয়ে ঝুড়ি বানাতে দেখা যায় পল্লীবধূকে। লোকজ বাংলার প্রতিচ্ছবিময় একটি চিত্রকর্মে উঠে এসেছে যাত্রাপালার দৃশ্যচিত্র। বিশাল সেই ক্যানভাসে পালার বিবেক দাঁড়িয়ে রয়েছে মঞ্চের মাঝখানে। তার পেছনে বসে কেউ বা সুর তুলেছে বাঁশিতে। বাকিরা ব্যস্ত রয়েছে একতারা, হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের সুরধ্বনি ছড়িয়ে দিতে। নদীতে ভাসমান এক জোড়া নৌকার ছবিটি স্মরণ করিয়ে দেয় নদীমাতৃক বাংলাদেশের রূপয়মতাকে। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ অবলম্বনে চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমের একটি ক্যানভাসে। বাংলার লোকশিল্প নামের বইয়ের প্রচ্ছদকে উপজীব্য করে সৃজিত ক্যানভাসটি প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় শিল্পরসিকের নয়নে। এর বাইরে নজর কাড়ে বিশ্বখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা বাদনের ছবিটি। নিরীক্ষাধর্মী কাজের মধ্যে চোখে পড়ে ত্রিমুখী অবস্থানরত তিনজন মানুষের অবয়বময় ছবিটি। এভাবেই বহুমাত্রিক বিষয়ের নির্র্যাসে বৈচিত্র্যময় রূপ পেয়েছে প্রদর্শনীটি। ৮৬ চারুশিক্ষার্থীর সৃষ্ট ৩১৪টি শিল্পকর্ম ঠাঁই পেয়েছে এই আয়োজনে। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলমান শিল্পায়োজনটি সকাল দর্শটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
হেমন্তের বিকেলে অনুষদের ওসমান জামাল মিলনায়তনে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম শেখ, গ্রাফিজ ডিজাইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মাকসুদুর রহমান ও পটুয়া কামরুল হাসানের মেয়ে সুমনা হাসান। সভাপতিত্ব করেন গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের চেয়ারম্যান ভন্দ্রেশু রীটা। এই অনুষ্ঠানের অতিথিরা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের ১৩টি শিল্পকর্মকে পুরস্কৃত করেন। এর মধ্যে একটি স্বর্ণপদক, একটি বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ, একটি শ্রেষ্ঠ নিরীক্ষামূলক, ছয়টি শ্রেষ্ঠ শ্রেণী এবং চারটি স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরীর মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের হাত ধরে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুগের চাহিদা ও কালের পরিক্রমায় বর্তমানে চারুকলার এই বিভাগটির বিকল্প নেই। অন্যদিকে গ্রাফিক ডিজাইনের বাজারও বিস্তৃত। কারণ, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে গ্রাফিক ডিজাইন। অন্যদিকে এই বিভাগটির বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা খুবই মেধাবী। প্রদর্শনীর শিল্পকর্মসমূহের তার নমুনা মেলে। পাশাপাশি শিল্পমাধ্যমটির বিকাশে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সুমনা হাসান বলেন, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা কামরুল হাসানের জন্মদিনেই এই প্রদর্শনীর সূচনা হওয়ায় ভালোলাগার অনুভব কাজ করছে মনে। তাই গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের জন্য কামরুল হাসান অ্যাওয়ার্ড চলমান থাকার পাশাপাশি এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদান করা হবে। এজন্য তহবিল গড়ে তোলা হবে। এসময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কামরুল হাসান প্রতিদিন ডায়রি লিখতেন। সেখানে তিনি দিনলিপি লেখার পাশাপাশি প্রচুর স্কেচ আঁকতেন। সব মিলিয়ে তার ৪৩টি ডায়রির খাতা রয়েছে। সেগুলো থেকে দুই খ-ের বই করা হয়েছে। এই বইগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা অংকনশলৈীর শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ের টুকরো টুকরো ইতিহাস জানতে পারবেন।
মনোয়ার