বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
শিল্পকলা একাডেমি থেকে চলচ্চিত্র বিভাগ বাদ দেওয়ার পরিবর্তে পৃথক চলচ্চিত্র বিভাগের দাবি জানিয়েছেন নির্মাতা, প্রযোজক থেকে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলেছেন, বাদ নয়, শিল্পকলা একাডেমিতে পৃথক চলচ্চিত্র বিভাগ চাই।
এ বিষয়ে রবিবার দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯-এর অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ’-এর খসড়াটি আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই বিবৃতি প্রদান করছি। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, নতুন খসড়া অধ্যাদেশে পূর্বের ’নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র’ উপবিভাগ থেকে কেটে চলচ্চিত্র অংশটুকু বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি, বরং চলচ্চিত্রকে পৃথক এক বিভাগ করার জন্য দাবি জানাচ্ছি। আমরা আমাদের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছি।
এছাড়া, গণঅভ্যুত্থানের পরে যখন নতুন সময়ে গণঅভ্যুত্থানকে ও মানুষের মুক্তিমুখীন লড়াইকে ধারণ করা এবং চলমান দেশগঠন ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ, এই নবজাগরণকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করতে পারে যে মাধ্যম, শিল্পকলার সেই অন্যতম শাখা চলচ্চিত্রকে একাডেমি থেকে বাদ না দিয়ে বরং স্বতন্ত্র বিভাগ গঠ করা হোক, আমরা সরকারের কাছে এই দাবি জানাচ্ছি।
কারণ জাতির বর্তমান প্রত্যাশা ও প্রয়োজনকে ছোট-বড়-প্রমাণ্য-ফিচার ইত্যাদি নানাধর্মী চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ধারণ করবে যে নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা, তার পৃষ্ঠপোষকতা বাণিজ্যিক আবহ করবে না, জাতীয় প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমিই সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে। একাডেমির সব জেলার শাখাগুলোয় এসব চলচ্চিত্রের ধারাবাহিক প্রদর্শন চলতে থাকবে, এটাই চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের আকাঙ্ক্ষা।
শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র বিষয়ক কার্যক্রমের বিষয়টি স্বাধীনতার পর থেকেই রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালের আইনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পাঁচটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই পাঁচটি বিভাগ ছিল-চারুকলা বিভাগ, নাট্যকলা বিভাগ, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিভাগ, চলচ্চিত্র (সিনেমাটোগ্রাফি) বিভাগ, গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ।
অর্থাৎ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শুরু থেকেই পৃথক ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ ছিল। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকার ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন রহিত করে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯’ জারি করে। ১৯৮৯ সালের এই আইনে চলচ্চিত্র বিভাগ বাদ দেয়া হয় এবং এই আইনে চলচ্চিত্রকে বাদ দেয়ার বিরোধিতা করে চলচ্চিত্র কর্মীরা প্রতিবাদ জানান।
তাদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পরিষদ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯ এর ৮ নং ধারার ২ নম্বর উপধারার অধিকার বলে চলচ্চিত্রকে নাট্যকলা বিভাগের সাথে যুক্ত করে ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভাগ’ গঠন করে চলচ্চিত্র বিষয়ক তৎপরতা পরিচালনা করে আসছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু থেকেই ‘চলচ্চিত্র’ তার অংশ হয়ে আছে। তাই ঐতিহ্য ও অধিকারের বিচারে, আজকেও শিল্পকলা একাডেমি থেকে চলচ্চিত্রকে বিদায় করে দেবার সুযোগ নেই।
চলচ্চিত্র একটি সমন্বিত শিল্পকলা, সব মাধ্যম থেকে ধার করে বিংশ শতাব্দি থেকেই সে অন্যতম শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠেছে। সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রকার হবার আগে ছবি আঁকতেন, ঋত্বিক ঘটক বা ইঙ্গমার বার্গম্যান প্রথমে থিয়েটার করতেন। এরকম বহু উদাহরণ আছে। ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে সিনেমাটোগ্রাফি শুরু করেছেন অনেকে। আবার জহির রায়হান সাহিত্যিকও ছিলেন, চলচ্চিত্রকারও ছিলেন। আলমগীর কবির সাংবাদিকতার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
একটা যুক্তি বরাবরই ছিল, চলচ্চিত্র দেখার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় আছে। তথ্য মন্ত্রণালয় দেখে চলচ্চিত্রের কারখানা (এফডিসি), সেন্সর ও সনদ, প্রশিক্ষণ (বিসিটিআই), সরকারি তথ্যচিত্র (ডিএফপি), চলচ্চিত্রের আর্কাইভ। কিন্তু এত কিছু থাকার পরও স্বাধীনতার পর থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র উপবিভাগ ছিল। কারণ শিল্পকলা বা আর্ট হিসেবে চলচ্চিত্রকে দেখার কোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল না। তাই শিল্পকলা একাডেমিতে বহু বছর ধরেই চলিচ্চত্রের শিল্পকলার দিকটি চর্চিত হয়ে আসছে।
এ কারণেই সম্প্রতি ফিল্ম সোসাইটি ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট নির্মাতাদের যাবতীয় কার্যক্রম শাহবাগ থেকে শিল্পকলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। ফিল্ম সোসাইটিগুলোর মধ্যে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি, শর্ট ফিল্ম ফোরাম, তরুণ ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার, সবার পদচারণার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল একাডেমি। দু’বছর পরপর যে ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল হয়, বা রেইনবোর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভাল, তারও অন্যতম ভেন্যু ছিল একাডেমি। শিল্পকলার মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র, এইসংস্থাগুলোয় ও এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে চর্চিত হতো। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান এফডিসি, ডিএফপি বা সেন্সর বোর্ডে এই চর্চা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমরা আশা করছি, শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে এবং নবনিযুক্ত সংস্কৃতি উপদেষ্টা এবিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি আমরা এও দাবি করছি, নতুন সময়ের দাবি ও প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার সংস্কৃতি নীতিমালারও প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করবে।
বিবৃতিতে নির্মাতা, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক, সমালোচক, গবেষক, অভিনয়শিল্পীসহ ১৭৫জন স্বাক্ষর করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন নির্মাতা ও প্রযোজক তাসমিয়াহ আফরিন মৌ, নূরুল আলম আতিক, আবু সাইয়ীদ, এন রাশেদ চৌধুরী, আকরাম খান, শবনম ফেরদৌসী, টোকন ঠাকুর, নোমান রবিন, ওয়াহিদ তারেক, প্রসূন রহমান, রেদওয়ান রনি, খিজির হায়াত খান, পলাশ রসুল, তানিম নূর, খন্দকার সুমন, শঙ্খ দাশগুপ্ত, লিটন কর, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, মোহাম্মদ আলী হায়দার প্রমুখ। সমালোচক-গবেষক ও শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ফাহমিদুল হক, আ-আল মামুন, বিধান রিবেরু, ইমরান ফিরদাউস, আমিরুল রাজিব, ওয়াহিদ সুজন, ড. সেলিম মোজাহার, সাদিয়া খালিদ রীতি, জাহিন ফারুক আমিন প্রমুখ।
চলচ্চিত্রকর্মী ও সংগঠকদের মধ্যে রয়েছেন মুনিরা মোরশেদ মুন্নী, তারেক আহমেদ, কাজী মামুন হায়দার, ড. সাজ্জাদ বকুল প্রমুখ। অভিনয়শিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন জাকিয়া বারী মম, রওনক হাসান, দীপক সুমন, সোহেল মন্ডল, নাহিদা শারমিন (শর্মীমালা), আব্দুল্লাহ আল সেন্টু ও তানভীর আহমেদ। এছাড়াও স্বাক্ষর দিয়েছেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন।
মনোয়ার/শহিদ