কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হলো বৈচিত্রের ঐক্য শীর্ষক বহুমাত্রিক অনুষ্ঠান
নানা ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষের সমন্বয়ে গড়া উঠেছে এই দেশ। বহুত্ববাদের এই বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেই গড়তে হবে বৈষম্যহীন স্বদেশ। বিনির্মাণ করতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। আর সেই সমাজে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে। দূর করতে হবে সাংস্কৃতিচর্চার প্রতিবন্ধকতাকে। সব মিলিয়ে বহু জাতি, ধর্মীয়, লিঙ্গীয় ও পেশাগত বিভাজন পেরিয়ে বৈচিত্র্যময়তাকে ধারণ করতে হবে।
আর এমন আকাঙ্ক্ষায় শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হলো বৈচিত্রের ঐক্য শীর্ষক বহুমাত্রিক অনুষ্ঠান। বিকেল থেকে রাত অবধি চলেছে এ আয়োজন। নাচের ছন্দে, গানের সুরে, নাটকের উপস্থাপনায় বর্ণিল রূপ নেয় অনুষ্ঠানটি। সঙ্গে ছিল অনুষ্ঠানের ভাবনির্ভর বিশিষ্টজনদের কথন।
নারায়ণগঞ্জের নরসিংহপুরে লালন মেলা বাতিলের নিন্দা জানানো এ অনুষ্ঠান থেকে। একইসঙ্গে রাজধানী থেকে অটোরিকশা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানানো হয়। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনার আশ্রয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। উন্মুক্ত মঞ্চে ঢোলের বাদনের সঙ্গে ভেসে বেড়ায় বাঁশি ও দোতারার সুর এবং মন্দিরার বাজনা। মিশ্রিত সেই সুরের মাঝে প্রকাশিত হয় ফকির লালন সাঁইয়ের গীতবাণী ‘মিলন হবে কত দিনে’। এরপর যন্ত্রসঙ্গীতের সুরে পরিবেশিত হয় জাতীয় সংগীত।
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের আকাঙ্ক্ষার আয়োজনে ম্রো ভাষার গান শোনান মেনথ্রাপ ম্রো। ভালোবাসার আর্তিময় সে গানেও উচ্চারিত হয় সহাবস্থানের কথা। পৃথিবীতে নতুন শিশুর আগমনী বন্দনাকে উপজীব্য করে নৃত্য পরিবেশন করেন আকরামুল হিজড়া। ওই নাচের সহযোগে উচ্চারিত হয় ‘দিদি লো খোকা হয়েছে না খুকি হয়েছে’ গানের বাণী। বহুমাত্রিক পরিবেশনায় দাদরা গান শোনান মিরঞ্জিল্লা। চাকমা ভাষায় সংগীত পরিবেশন করেন সংজোয়ার। কাওয়ালি পরিবেশন করেন নাজিম কাওয়াল।
এছাড়া একক কণ্ঠে গান শোনান বাউল সুনীল কর্মকার, রামিসা চৌধুরী, কফিল আহমেদ ও কৃষ্ণকলি। নাচ করেন প্রিয়া খান। জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি জাগানিয়া ‘আবার ফাল্গুন’ শিরোনামের নাটক পরিবেশন করে নাট্যদল বটতলা।
কথন পর্বে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এ দেশ শুধু বাঙালির কিংবা মুসলমানের নয়। বহু জাতি, ধর্ম, ভাষা ও লিঙ্গের সম্মিলন ঘটেছে এই বাংলাদেশে। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিও এমন বৈচিত্রেরই বারতা দেয়। তাই প্রকৃতিকে ধরেই বৈচিত্র্য টিকে থাকে। বৈচিত্র্যের মাঝেই গড়ে ওঠে ঐক্য।
আর ঐক্যের মাঝে তৈরি হয় শক্তি। অথচ সেই ঐক্যকে নষ্ট করে লালন মেলার মতো অনুষ্ঠান বাতিল করছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীটি সব সময়ই সৃজনশীল কর্মকান্ডের বিরোধী। অথচ লালন সাঁই ও শাহ আব্দুল করিমের মতো মানুষদের সৃষ্টিশীলতার মাঝে রয়েছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
তাই সব বাধা পেরিয়ে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হবে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, অটোরিকশার ওপর বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে। তাই অটোরিকশাকে বাতিল না করে বরং বাহনটি ত্রুটি সরিয়ে সেটি উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি মজুরিসহ শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি মেনে নিতে হবে।
অনুষ্ঠানের মূল ভাবকে ধারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মঞ্চশিল্পী সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, আমরা চাই আগের অবস্থার পরিবর্তন করে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। মানুষ জীবন দেবে অথচ কতিপয় গোষ্ঠী লুট করবে আর খবরদারি করবে এই অবস্থা আর চলতে দেয়া যাবে না।
কিন্তু রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পরেও দেখছি আগের মতো শ্রমিক মার খাচ্ছে, দখল চাঁদাবাজী জুলুম হচ্ছে; ধর্ম, জাতি, লিঙ্গীয় বা পেশাগত-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নামে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে। এদের পরাস্ত করে দেশের সকল বৈচিত্র্যের নিপীড়িত মানুষেরা এক হয়ে বলতে চাই আমরাই আসল বাংলাদেশ! দিকে দিকে আওয়াজ তুলুন বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যমুক্ত সর্বজনের বাংলাদেশ চাই।
এছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন রিক্সা-ভ্যান ও ইজি বাইক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস।
মনোয়ার/শহিদ