বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান কক্ষে ‘হাসান আজিজুল হক : দেশ ভাগের অন্ধ সুরকার’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন কথাসাহিত্যিক এহসান মাহমুদ
তাঁর লেখার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে সংগ্রামী মানুষের জীবনচিত্র। সুঠাম গদ্যের মর্মস্পর্শী বর্ণনায় তিনি লিখে গেছেন প্রান্তিকজনের জীবনের কথকতা। তাঁর অনেক গল্পের পটভূমি হয়েছে রাঢ়বঙ্গের সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সাতচল্লিশের দেশভাগের অন্তর্গত বেদনাকে ধারণ করে লিখেছেন কালোত্তীর্ণ উপন্যাস। নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সেই কীর্তিমান কথাশিল্পী হলেন হাসান আজিজুল হক। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারজয়ী প্রয়াত এই কথাসাহিত্যিককে স্মরণ করা হলো সোমবার। তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল্যায়নধর্মী সে আলোচনায় বক্তারা বলেন, রাঢ়বঙ্গের স্মৃতিকে গল্পের অক্ষরে ফুটিয়ে তুলেছেন হাসান আজিজুল হক। বর্ণাঢ্য লেখকজীবনে দেশভাগকে করুণ সুরে লিখে গেছেন। অন্যদিকে তাঁকে কোনো বৃত্তবন্দিভাবে বিচার করা যায় না। বারবার ভেঙে গেছেন তিনি।
হেমন্তের বিকেলে বাংলা একাডেমির আয়োজনে হাসান আজিজুল হক স্মরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘হাসান আজিজুল হক: দেশভাগের অন্ধ সুরকার’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহ্সান মাহমুদ। স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতি, পত্রিকা ও মিলনায়তন বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. সরকার আমিন। আলোচনায় অংশ নেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম ও ওয়াসি আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
এহ্সান মাহমুদ বলেন, হাসান আজিজুল হক দেশভাগের অন্ধ সুরকার। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে দেশভাগের ফলে সৃষ্ট মানবিক ও সামাজিক বিপর্যয়কে তিনি শিল্পিত বিবরণে লিখে গেছেন। তাঁর লেখায় দেশভাগের আগেকার যে রাঢ়বঙ্গের দেখা পাওয়া যায়, তার পরের বাংলাদেশের ঠিক ততখানি দেখা মেলে না। সব মিলিয়ে হাসান আজিজুল হক যেন তাঁর গোটা লেখকজীবনে দেশভাগকে করুণ সুরে লিখে গেছেন।
আলোচকদ্বয় বলেন, হাসান আজিজুল হক কোনো পৃষ্ঠপোষকতার তোয়াক্কা করেননি বরং তিনি তাঁর লেখার গুরুত্বের কারণেই খ্যাতিমান লেখক হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। সারাজীবন প্রান্তে বসবাস করে তিনি সাহিত্যের নতুন কেন্দ্র তৈরি করেছেন। সামান্য দৃশ্যকে বৃহৎ ক্যানভাসে তুলে ধরার কৃতিত্বে তিনি অসাধারণ, বিন্দুতে সিন্ধু ধারণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তারা বলেন, হাসান আজিজুল হককে বৃত্তবন্দিভাবে বিচার করা যাবে না। তিনি বারবার বৃত্ত ভেঙেছেন। শৈশব-কৈশোরের রাঢ়বঙ্গের স্মৃতির রঙে যেমন তাঁর গল্প রাঙা হয়েছে তেমনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের মরণপণ জীবনসংগ্রাম তাঁর মতো সার্থকভাবে খুব কম কথাশিল্পীই সাহিত্যে ধারণ করতে পেরেছেন। হাসান আজিজুল হক সংকটের ছবি এঁকেছেন বারংবার কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি অনিঃশেষ আশাবাদেরই মানুষ।
সরকার আমিন বলেন, অসাধারণ শিল্পকুশলতায় রাঢ়বঙ্গের স্মৃতিকে গল্পের শ্যামল অক্ষরে ফুটিয়ে তুলেছেন হাসান আজিজুল হক। তিনি তাঁর হারিয়ে যাওয়া সোনালি বাল্যকাল দিয়ে ধূসর পৃথিবীর মোকাবিলা করতে চেয়েছেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদ যেমন আছে তেমনি তার আড়ালও আছে। কোনো সরল তত্ত্বরেখায় তাঁকে ব্যাখ্যা করে চটজলদি সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তিনি বলেন, হাসান আজিজুল হক আশির দশক পর্যন্ত তাঁর শিল্পচর্চাকে যেভাবে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন পরবর্তীকালে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানের কারণে হয়তো সে মাত্রায় থাকেনি। কিন্তু অতি অবশ্যই তিনি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার।