ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষ্যবহ শিল্পিত পরিবেশনা ‘লাল মজলুম’

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:৫২, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষ্যবহ শিল্পিত পরিবেশনা ‘লাল মজলুম’

ঢাবি রাজু ভাস্কর্য থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যাত্রার উন্মুক্ত রাজপথ-গণপরিবেশনা ‘লাল মজলুম’ পরিবেশন করে থিয়েটার পারফর্মেন্সের নাট্যকর্

টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে শাহবাগ অবধি বয়ে গেল ভিন্ন এক শিল্পিত স্রোতধারা। সেই স্রোতধারার মাঝে মিশেছিল দ্রোহের বীজ। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে উত্তাপে জ্বলে ওঠা মানুষের ক্ষোভ। মিশেছিল দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সংকল্প। আর সেই গণপরিবেশনায় শিল্পীদের সমান্তরালে শামিল হলেন সাধারণ মানুষ। তারাও যেন হয়ে উঠলেন ওই রক্তঋণের সাক্ষ্যবহ সেই শিল্পের অংশীদার। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতিময় সেই গণপরিবেশনাটির শিরোনাম ছিল ‘লাল মজলুম’। শনিবার হেমন্তের বিকেলে গণঅর্থায়নে নির্মিত পরিবেশনাটি উপস্থাপিত হলো রাজধানীর রাজপথে।
আয়োজনের শুরুতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে একদল ফকির-সন্ন্যাসীকে গান গাইতে দেখা যায়। হঠাৎ করে হেলমেট পরা একদল যুবক তাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। পরক্ষণেই শোনা যায় আগুনঝরা স্লোগান- ‘আমার ভাই মরলো কেন, জবাব দে জবাব দে’; ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’; ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালাও এক সাথে’। স্লোগান দিতে দিতে একটি মিছিল এগিয়ে যায় শাহবাগের দিকে। কিছু দূর যেতেই সেখানে আবারও হামলা করা হয়। এ সময় পরিবেশনাটিতে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। এক সময় লুটিয়ে পড়া জনতার ভেতর থেকে তরুণরা জেগে ওঠে। তাদের মুখে শোনা যায় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলা ও চাকমা ভাষার রূপান্তরিত উচ্চারণ। তাদের পেছনের দেওয়ালে কালো কাপড়ে লেখা ‘আমার হুকুমে সব চলবে’; ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’; ‘আমার জীবন জনগণের জন্য নিবেদিত’ ইত্যাদি কথা সরিয়ে ফেলে তরুণরা। সেখানে স্থান পায় ফকির সন্ন্যাস বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ,  স্বৈরাচারবিরোধী ইত্যাদি আন্দোলনের চিত্রমালা। এসময় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাইদ, ঊনসত্তুরের শহীদ আসাদ, একাত্তরের তারামন বিবি প্রমুখের চরিত্রের শিল্পীরা বলেন, তারা মরেন নাই। সময়ের প্রয়োজনে তারা ফিরে ফিরে আসেন।
এই দ্রোহী দলটি আরও সামনে গিয়ে কালো রঙে বানানো একটি চারকোনা আকৃতির ঘর দেখতে পায়। যার গায়ে লেখা ‘রাষ্ট্রীয় আয়নাঘর অথবা আরশিনগর’। সেটিকে তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এর ভেতর পাওয়া যায় মৃতদের কঙ্কাল। এসব দেখে তরুণরা শোকে বিহবল হয়ে পড়ে। বুক চাপড়ে বিলাপ করতে থাকে তারা। তাদের উজ্জীবিত করে আরেকদল তরুণ। তারপর তারা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে এবং চলচল লাল মজলুম চল স্লোগান দিতে দিতে শাহবাগে স্থাপিত জাতীয় রিফর্মেশন মিউজিয়ামের সামনে পৌঁছে। এক পর্যায়ে সেখানে বসে গণসংসদ অধিবেশন। সেখানে অভ্যুত্থান ও পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
লাল মজলুমের ভাবনা, পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শাহমান মৈশান। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই পরিবেশনা। তিনি এটিকে একটি প্রতীকী পরিবেশনা বলেছেন। তার মতে, এই পরিবেশনা অসমাপ্ত। দীর্ঘদিন তারা কথা বলতে পারেননি। জবান বন্ধ ছিল। এখন তাদের জবান খুলে গেছে। পরিবেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লাল মজলুম হচ্ছে ক্রাউড ফান্ডিংয়ে নির্মিত একটি রাজপথ-গণপরিবেশনা। একদিকে শিক্ষার্থী-শ্রমিক জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতি যেমন রোমন্থন করে পুনঃসৃজন করে, তেমনি এই জনপদে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানকেও একসূত্রে গ্রথিত করে। এর বাইরে জনগণের রাজনৈতিক আত্মত্যাগের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে এক অবিরত সংগ্রামের প্রযোজনীয়তাকে জনপরিসরে মেলে ধরতে সৃজিত হয়েছে এই শিল্পরূপ।

×