মীর তাজ স্কয়ারে মঞ্চস্থ তবুও জেগে উঠি নাটকের দৃশ্য।
শিশুকালের নির্মলতা নিয়ে একসাথে বড় হয় একদল ছেলে-মেয়ে। শ্রেণীকক্ষে তারা পাশাপাশি বসলে শিক্ষক এসে লিঙ্গ ভেদে তাদের পৃথক করে দেয়। টেনে দেওয়া হয় নারী-পুরুষের বিভেদরেখা। সেই থেকে বিভাজন শুরু। এরপর তারা শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে পরিণত বয়সে পৌঁছালে আগ্রাসী রূপ নেয় সেই বিভেদ। নারীর ওপর চলতে থাকে পুরুষের নির্যাতন। শিকার হতে হয় শারীরিক নিপীড়নের। আটা-ময়দার মতো ছানা হয় নারীর শরীর। উল্টোদিকে তার চলার পথেও নেমে আসে প্রতিবন্ধকতা। হারিয়ে যায় নারী-পুরুষের সহাবস্থান।
নারী একটু এগিয়ে গেলেই পেছন থেকে টেনে ধরে পুরুষ থামিয়ে দেয় তার পথচলা। তবে শেষ পর্যন্ত নিপীড়ন-নির্যাতনকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়ায় নারী। প্রতিবাদের সোচ্চার হয় তাদের কণ্ঠস্বর। এমনই প্রতিবাদী চেতনার গল্পময় নাটক ‘তবুও জেগে উঠি’। পারফরমেন্স আর্ট ঘরানার নতুন প্রযোজনাটি মঞ্চে এনেছে নাট্যদল স্পর্ধা : ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ। মার্কিন কবি মায়া অ্যাঞ্জেলোর ‘অ্যান্ড স্টিল আই রাইজ’ কবিতার ভাবানুবাদ থেকে নির্মিত নাটকটি পরিকল্পনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন মহসিনা আক্তার। বৃহস্পতিবার রাত আটটা ও দশটায় নাটকটির প্রথম ও দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হয় পান্থপথের মীর তাজ স্কয়ারে। নাটককে দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ওই ভবনের একটি ফ্লোরকে স্টুডিওরূপে ব্যবহার করা হয়েছে।
সংলাপের পরিধি কমিয়ে মূলত সংগীত আবহের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে ঘটনাপ্রবাহ। নতুনত্বের সন্ধানী পরিবেশনাটিতে প্রাধান্য পেয়েছে অভিনয়শিল্পীদের শরীরী ভাষা ও অভিব্যক্তি। মঞ্চশিল্পীদের দক্ষতায় স্বল্প সংলাপে সৃষ্ট প্রযোজনাটি স্বার্থকভাবেই মেলে ধরছে কাহিনীকে। অন্যদিকে বাহুল্যবর্জিত মঞ্চসজ্জার সঙ্গে কয়েকটি চেয়ার ও একটি বালতি ছাড়া নেই প্রপসের ব্যবহার। সব মিলিয়ে স্বল্প অনুষঙ্গের প্রয়োগে তৈরি হয়েছে ৪৫ মিনিটের পারফরমেন্সধর্মী প্রযোজনাটি। নাটকের ভেতর নাটকীয়তা সৃষ্টিতে নিদের্শকও একপর্যায়ে যুক্ত হন গল্পের ভেতর। আর সেই সময় নিদের্শকের নারী পরিচয়কে কটাক্ষ করেন পুরুষ অভিনয়শিল্পীরা। এছাড়া দর্শকের সঙ্গে নাটকের সংযোগ সৃষ্টিতে পুরুষের কাছে মার খাওয়া নারী শিল্পী সরাসরি চলে আসেন দর্শকের কাছে। তাকে রক্তাক্ত করা লোহার রডটি তুলে দেন দর্শকের হাতে।
প্রযোজনাটি প্রসঙ্গে নিদের্শক মহসিনা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সব ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে বারংবার। কিন্তু পূর্বের মতো এই সময়েও নারীর পথচলার ক্ষেত্রে সংস্কার ঘটেনি। দূর হয়নি প্রতিবন্ধকতা। নারীর স্বাধীনতার শৃঙ্খল পরানোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বন্ধ হয়নি নারীর প্রতি সহিংসতা। হরহামেশাই নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। বৈষম্যহীনতার কথা বলা হলেও নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়নি। সব মিলিয়ে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্পর্ধার প্রতিবাদী উচ্চারণ এই প্রযোজনাটি। এই নাটকের মাধ্যমে সমসাময়িক বিষয়নির্ভর সিরিজ কাজের শুরু করলো স্পর্ধা। পরের সিরিজে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের অসহায়ত্ব, মানবিক সংকট, বিচারবহির্ভূত হত্যকা- নিয়ে নাটক করবো।
নাটকের পটভূমিতে বলা হযেছে, জন্মের আদিলগ্ন থেকে নারীর সাথে আমাদের নাড়ীর টান। শিশুকালের নির্মলতা নিয়ে সকলে একসাথে বড় হই আমরা তবু একটু বয়স হলেই কারা যেনো বারবার মনে করিয়ে দেয় নারী-পুরুষ আলাদা, ভিন্ন জাত। পুরষতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন ব্যবস্থায় এরপর কোনোভাবেই আর একত্রে দাঁড়াতে দেয়া হয় না নারীদের। স্বীকার করা হয় না তার কোনো অবদান। একত্রে অর্জিত মাইলফলক পেরোনোর পরমুহূর্তেই সমাজের মনে হয় নারীর স্থান আড়ালে, সবার সামনে নয়, উঠেপড়ে ধেয়ে আসা হয় নারী সংস্কার যজ্ঞে। এভাবেই নিপীড়নের যন্ত্রণার সাথে নারীর আজন্ম বসবাস। দলিতমথিত হয়ে প্রতিমুহূর্তে ভূলুণ্ঠিত হওয়াই যেন তার জীবন। তবুও, বারবার ঝাড় দেয়া ঘরের কোণ থেকে যেমন করে ধুলো জেগে ওঠে, সতর্কতা বার্তা ছাড়াই শান্ত থমথমে বাতাস থেকে যেমন ঝড় জেগে ওঠে, তেমন করেই বারবার উঠে দাঁড়ায়, ঘুরে দাঁড়ায়, টেনে-হিঁচড়ে হলেও এগিয়ে যায় নারী।
প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শারমিন আক্তার শর্মী, সিফাত নওরীণ বহ্নি, ফারিহা জান্নাত মিম, মরিয়ম রূপা, নাঈমা তাসনিম, রিয়াসাত সালেকিন ঋত্বিক, সাইফুল ইসলাম, রবি প্রারম্ভ, সালাউদ্দিন ইভান ও মোঃ মেহেদী হাসান সোহান। নির্দেশনা সহযোগী হিসেবে রয়েছেন শাহানাজ পারভীন জোনাকি। কবিতা থেকে নাটক রূপান্তরে ভাবানুবাদ করেছেন রিয়াসাত সালেকিন ঋত্বিক ও ফারিহা জান্নাত মিম।
মনোয়ার/ রিয়াদ