নাগরিক জীবনে চাইলেই সহজে ফেরা যায় না শেকড়ের পানে। লোকায়ত জীবনের পানে ফেরার স্বপ্নটা তাই অধরাই রয়ে যায়। আকাক্সক্ষা থাকলেও আপন কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে আলিঙ্গন ঘটে না। কংক্রিটের শহর ঢাকায় এসেছে সেই সুযোগটি।
অতৃপ্তি ঘুচিয়ে লোকায়ত জীবনের প্রতিচ্ছবিময় যাত্রাপালা সুযোগ মিললো আপন সংস্কৃতির অনুরাগী শহরবাসীর। শুক্রবার ছুটির দিনে আবহমান গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় এই লোকনাট্য ধারা উপস্থাপিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে।
খোলা আকাশের নিচে টাঙানো প্যান্ডেলে উচ্চারিত হলো উচ্চকণ্ঠের সংলাপ। কাহিনীর উন্মোচনে বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে হাজির হলো সত্য ও ন্যায়ের প্রতীকী রূপ বিবেক। দেশজ নানা বাদ্যযন্ত্রের সুরের সঙ্গে সংলাপের সমন্বয়ে এগিয়ে চলা কাহিনী পূর্ণ মনোযোগ ধরে রাখলো দর্শকের। এভাবেই লোকায়ত জীবনের আবাহনে মুগ্ধতার ছবি এঁকে শুরু হলো সপ্তাহব্যাপী যাত্রা উৎসব।
সাত নভেম্বর অবধি চলমান উৎসবে বিভিন্ন জেলার নিবন্ধিত ৭টি যাত্রা দল প্রতিদিন একটি করে ঐতিহাসিক ও সামাজিক ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত যাত্রাপালা পরিবেশন করবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু হবে পালার পরিবেশনা।
বিনা দর্শনীতে দর্শকরা উপভোগ করবেন এই পালাসমূহ। ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে এ উৎসবের আয়োজক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ। কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসা গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত যাত্রাশিল্পকে টিকিয়ে রাখার অংশ হিসেবে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
হেমন্তের সন্ধ্যায় উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ছাত্র জনতার গণঅভ্যত্থানে অংশগ্রহণকারী ইসরাফিল মজুমদার। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিশিষ্ট যাত্রা শিল্পী অনিমা দে। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জাহির।
সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক নাট্য নির্দেশক ও শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। উৎসবে দর্শক হিসেবে আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন আইন ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
উদ্বোধনী আলোচনায় অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, শিল্পচর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এবং গ্রামীণ জনসাধারণের বিনোদনের ঐতিহ্য বিবেচনায় আমরা এই যাত্রাপালার আয়োজন করেছি। আমরা চাই, আপনারা সবাই যাত্রা শিল্পীদের পাশে থাকুন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, শৈশবে আমরা নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করেছি ‘সামাজিক’ যাত্রাপালাগুলো দেখে।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় যাত্রাশিল্পকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে, সেই পরিস্থিতির আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। সুস্থ ধারার যাত্রাপালা পরিবেশনা, মানোন্নয়ন, চর্চা এবং যাত্রাশিল্পীদের পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে ঐহিত্যবাহী যাত্রাপালাকে জনজীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
আলোচনা শেষে পরিবেশিত হয় নিহত গালাপ শিরোনামের পালা। পালাকার আগন্তুকের লেখা সুরভী অপেরা পরিবেশিত পালাটির নির্দেশক কবির খান। এই পালা মাধবপুর জমিদারের চক্রান্তের এক অতি বাস্তব কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। করুণ কাহিনীনির্ভর সেই চক্রান্তের বলি হয়েছিল রাধারানী কলেজের মেধাবী ছাত্র গোকুল। জমিদারের আত্মীয়কে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করানোর কারণে গোকুলের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
গোকুলকে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয় ‘নিচু জাতের’ ছেলে বলে। পরর্বীতে সে সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভাগ্যের ফেরে তার প্রেমিকা যৌনপল্লীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কোন একদিন গোকুল ছিনতায়ের অপরাধে ঐ পল্লীতে আশ্রয় নেয়। অবশেষে একদিন সে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিচারে তার সাজা হয়।
আজ শনিবার দ্বিতীয় দিনে নিউ শামীম নাট্য সংস্থা পরিবেশন করবে প্রসাদ কৃষ্ণ ভট্টচার্য রচিত ও শামীম খন্দকার নির্দেশিত আনারকলি শিরোনামের পালা। রবিবার তৃতীয় বঙ্গবাণী অপেরা পরিবেশন করবে রঞ্জন দেবনাথ ও মানস কুমার নিদের্শিত পালা ‘মেঘে ঢাকা তারা’।
সোমবার নর-নারায়ণ অপেরা পরিবেশন করবে দেবন্দ্রনাথ রচিত ও রোজেন কুমার বিশ্বাস নিদেশিত পালা ‘লালন ফকির’। মঙ্গলবার, বন্ধু অপেরা উপস্থাপন করবে শামসুল হক রচিত ও মনির হোসেন নিদের্শিত পালা পালা ‘আপন দুলাল’।
বুধবার শারমিন অপেরা পরিবেশন করবে পুর্নেন্দু রায় রচিত ও শেখ রফিকুল নির্দেশিত পালা ‘ফুলন দেবী’। উৎসবের শেষ দিন বৃহস্পতিবার যাত্রাবন্ধু অপেরা পরিবেশন করবে শ্রী শচীননাথ সেন রচিত এবং আবুল হাশেম নিদের্শিত পালা ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’।