ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

মধুসূদন মঞ্চে যেন প্রাণ পেলেন ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ

মারুফ রায়হান, কলকাতা থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

মধুসূদন মঞ্চে যেন প্রাণ পেলেন ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ

‘দেখি নাই ফিরে’ নাটকের একটি দৃশ্য

কলকাতার দেশ পত্রিকায় আমরা গোগ্রাসে গিলতাম কালজয়ী চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের জীবন নিয়ে লেখা খ্যাতিমান লেখক সমরেশ বসুর উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’। বিশিষ্ট শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য উপন্যাসটির সচিত্রকরণ করেছিলেন। সেগুলো ছিল একেকটি চমৎকার শিল্পকর্ম। সে ৩৬-৩৭ বছর আগের কথা। তরুণ রামকিঙ্কর শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকা শিখতে গেলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রকৃত প্রতিভাকে সঠিকভাবে শনাক্ত করে বলেছিলেন, কাজ করে যাবে, কখনো পেছনে ফিরে দেখবে না।

সে কথায় পরে আসছি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পোস্টার এঁকে ভূমিকা রাখা এ খ্যাপাটে ছাত্রটি শান্তিনিকেতনে শিল্প-শিক্ষক নন্দলাল বসুর কাছে এসে নবজীবন পান; জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেখানেই শেকড় ছড়িয়েছেন। এ উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ভাস্কর রামকিঙ্করের জীবনভিত্তিক নাটক ‘কলের বাঁশি’ মঞ্চে এনেছে হাওড়া সৃজন এবং আমার স্বল্পকালীন কলকাতা ভ্রমণের মাঝেই নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে মধুসূদন মঞ্চে, এই সংবাদ জানার পর নাটক না দেখে কি থাকা যায়? আমাদের বন্ধু, জীবাংলার সারেগামাখ্যাত শিল্পী সম্পা বিশ^াস আগাম টিকিট কেটে রাখলেন। দুজনে চলে গেলাম কাক্সিক্ষত গন্তব্যে।

আগেভাগে বলে রাখছি, সমরেশ বসু উপন্যাসটি শেষ করে যেতে পারেননি। বেশ কয়েক বছর তিনি রামকিঙ্করের কাছে গেছেন, শিক্ষার্থীর মতো পরম নিষ্ঠায় শিল্পীর জীবনের গল্প নোটবুকে টুকে নিয়ে এসেছেন। লেখকপুত্র নবকুমার বসু জানাচ্ছেন তাঁর বাবা বলতেন, ‘শান্তিনিকেতন এবং তখনকার নানান লোকজন সম্পর্কে যেসব তথ্য পেয়েছি... কাহিনি ঘটনা হিসেবেও সেসব সাগরদা (সম্পাদক সাগরময় ঘোষ) দেশ পত্রিকায় ছাপতে পারবেন কি না কে জানে?’ নাটকে অবশ্য খুবই সামান্য ইঙ্গিত আছে এসবের। নাক উঁচু চিত্রশিল্পীদের কেউ কেউ তাঁকে অবজ্ঞাভরে বলতেন রামকিঙ্কর বেজি।

রবীন্দ্র সংগীতের এক নারী শিক্ষক রামকিঙ্করকে কঠোর ভর্ৎসনা করেছিলেন তাঁর উঁচু তলার ছাত্রীর সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলতেন বলে। অর্থাভাববশত বাঁকুড়ার গাঁয়ের বাজারে পিতার পেশা ক্ষৌরকর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন কিশোর রামকিঙ্কর। এই পরিচয় কিছুতেই ভুলতে পারতেন না শান্তিনিকেতনের অনেক সংগীত ও চিত্রশিল্পী।
বিতান ভট্টাচার্যের একটি লেখায় উৎকীর্ণ হয়ে আছে রবি ঠাকুরের সঙ্গে রামকিঙ্করের কথোপকথনের আকর্ষণীয় কাহিনী। কিছুটা না পড়লে সঠিক ব্যঞ্জনা পাওয়া যাবে না। তিনি লিখছেন : ‘রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠিয়েছিলেন তরুণ ভাস্করকে। তাঁকে নিয়ে নানা কথা ভেসে বেড়ায়। তাঁর শিল্প ভাবনা, তাঁর কাজের ধরন, তাঁর ব্যক্তি জীবন। কিঙ্কর এসে দাঁড়ালেন অবনত হয়ে। রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘কার মূর্তি গড়েছ কিঙ্কর?’

কবির প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মনে পড়ল মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর কথা : ‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনো স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’ তাই মুখ তুলে বললেন, ‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি নে। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’
তখন লেখার খাতায় নজর কবির। দুই শিল্পীর কথপোকথন চলতে থাকে। কিঙ্করের অস্বস্তি বাড়তে থাকে কবির প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে। খেই হারায়। এক সময় রবীন্দ্রনাথ ফিরে তাকান আনমনা কিঙ্করের দিকে। বলেন, ‘একটি পাখি কি উড়ে যেতে চায় আকাশে? পাখা তার যেন সেই রকম তুলে দিয়েছে।’ চোখের পাতা ভিজে আসে তরুণ ভাস্করের। মুখ নামিয়েই অস্ফুটে বলেন, ‘একটি মেয়ে পাখি হয়তো তার বুকের নিচেই আছে!...’
রবীন্দ্রনাথ সেদিন রামকিঙ্করকে যা বলেছিলেন সেটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আপ্তবাক্য হিসেবেই স্মরণে রেখেছেন। কথাটি ছিল, ‘যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে।  পেছনে আর তাকাবে না।’ 
রামকিঙ্করের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে বেশ ক’জন নারীর, এই সম্পর্ক তাঁর কাছে ছিল নানামাত্রিক। প্রত্যেকেই তাঁর শিল্প-প্রেরণা হয়ে এসেছে; কখনোবা হয়েছে ক্রান্তিকালে জীবনদায়িনী। এসব সম্পর্ককে তৎকালীন সমাজ সহজভাবে নিতে পারেনি। তা ছাড়া নগ্নতাকে রামকিঙ্করের মতো শিল্পীরা দেখেন বিশুদ্ধ সৌন্দর্য হিসেবে, যা সুশীল সমাজের চোখে অন্যতর হয়ে দেখা দিতে পারে। এখানেই শিল্পীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের দেখার চোখের ব্যবধান। 
কলের বাঁশি নামে একটি বিখ্যাত ভাস্কর্য আছে রামকিঙ্করের, আর এ নামেই নামকরণ মঞ্চনাটকের। প্রথম দুটি দৃশ্য দেখে মুষড়ে পড়েছিলাম, খুবই গতানুগতিক দৃশ্যনির্মাণ ও সংলাপ। টানা দু’ঘণ্টার নাটক শেষ পর্যন্ত দেখার আগ্রহ থাকবে কি না এমনটি ভাবাও শুরু করেছিলাম। অবশ্য খানিক পরই রামকিঙ্করের শৈশব ও যৌবনের যেসব ছবি ফুটে উঠতে থাকলো মঞ্চে, তাতে নড়েচড়ে বসলাম। শেষ দৃশ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই বুঝতে পারলাম এ মঞ্চসফল নাটক দর্শকপ্রিয় হবে।

রামকিঙ্করের ভূমিকায় সঞ্জীব সরকারের অভিনয়নিপুণতাই নাটকটিকে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করেছে। টেকনিক হিসেবে ছায়াঅবয়বের উপস্থাপন ও পর্দায় সচল ছবির প্রদর্শন সংগতই মনে হয়েছে। যদিও বিকাশের শিল্পকর্ম দেখানোর সুযোগ গ্রহণ করেন নি নির্দেশক। রামকিঙ্করসৃষ্ট চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যের ইমেজ (বা ছবি) প্রদর্শনে আরও কুশলী ও কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। 
কলকাতার শিল্পজগতের মানুষেরা আপন ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করেন এবং সে কারণেই  একেকজন গ্রেট আর্টিস্টকে নিয়ে, তা যে শিল্পশাখারই হোক না কেন, শিল্পসৃষ্টি করেন। তাই রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে পূর্ণদৈর্র্ঘ্য নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। এমন বিচিত্র জীবনধারার চিত্রশিল্পী আমাদেরও আছেন। এঁদের দু’জন হলেন সুলতান ও জয়নুল।

এস এম সুলতানকে নিয়ে অবশ্য ডকুমেন্টারি হয়েছে, কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে আমিও ডকুমেন্টারি বানিয়েছি ২৫ বছর আগে। সে যাক, চলচ্চিত্রে ও থিয়েটারে বাংলাদেশের সেরা সব ব্যক্তির জীবন যদি আমরা শিল্পসম্মতভাবে তুলে আনতে পারি, তবে অনাগত প্রজন্ম স্বদেশ ও স্বজাতি নিয়ে গর্ব করার উপাদান পাবে। সময় এসেছে শিল্পের এই জায়গাটিতে দৃষ্টি দেওয়ার।

×