সাক্ষাৎকার
আজাহারুল ইসলাম, ইবি : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম শোনেননি এমন কেউ হয়তো বাংলাদেশে নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বাংলার খবর প্রচারে যার জুড়ি নেই। তেমনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে একদল বাংলাদেশি তরুণ বিভিন্ন বিদেশি মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য সরবরাহ করতো।
বাংলাদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ইংরেজিতে অনুদিত করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের দৃষ্টি আকর্শনে নিরলস কাজ করে গেছে। শতাধিক তরুণ শিক্ষার্থী এই কাজে অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ট্রান্সলেটর ছিল। আর এই টিমের রূপক নাম তারা দিয়েছিল, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
এই টিমের প্রধান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের স্নাতক ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক ফেরদৌস ইমনের নেতৃত্ব। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-সমন্বয়কও ছিলেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি আজাহারুল ইসলাম।
জনকণ্ঠ: কী ধরনের কাজ করেছিলেন এবং এই চিন্তা কীভাবে মাথায় এলো?
ইমন: কোটা আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর যখন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হামলা করে এবং পুলিশ নির্মমভাবে শিক্ষার্থীদের মারা শুরু করে তখন একজন আন্দোলনকারী হিসেবে আমি খুব করে চাচ্ছিলাম বহির্বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো যাতে এ বিষয়ে কথা বলেন।
আমরা চাচ্ছিলাম যদি কোনোভাবে বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে নিউজ করে মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। তাই আমি সারাদিন আন্দোলন শেষে বাড়ি ফিরে ২৮ জুলাই একটা টিম গঠন করি। যেটা সারাদিনে যত বাংলা নিউজ পেয়েছি সেগুলোকে ট্রান্সলেট করে আন্ততর্জাতিক সকল গণমাধ্যমে মেইল করবো।
জনকণ্ঠ: এই কাজে কী ধরণের বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন?
ইমন: সেসময় নির্বিচ্ছন্নভাবে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না এবং বারবার বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে ঢুকে নিউজগুলো দেখাও ছিলো অনেক সময়ের কাজ। তবুও আমরা চেষ্টা করতাম বাংলাদেশের সকল নিউজ পোর্টাল/পেপারের নিউজগুলো কভার করার। ছেলেরা সরাসরি সারাদিন রাজপথে আন্দোলনে থাকতো। আর মেয়েরা বাসায় বসে নিউজ সংগ্রহ করে সাহায্য করতো। তারা সারাদিন নিউজগুলো সংরক্ষণ করতো এবং আমরা রাতে ফিরে সবাই একসাথে সেগুলো নিয়ে কাজ করতাম।
জনকণ্ঠ: কী কী কাজ করতে পেরেছেন?
ইমন: প্রথমেই একটা টিম রেডি করি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শাফিনুর রহমান তন্ময় ও হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এই বর্ষের এম এ বারি শরিফ আমাকে সাহায্য করে। আমাদের সেই টিমে ২০ জন কাজ করছিল।
তারপর ভাবলাম জেলার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই কাজে সংযুক্ত করা যায়। পরে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন টিম গঠন করি। আমরা স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করে ইংরেজিতে অনুবাদ করতাম। পরে একসাথে সেগুলো মেইল করতাম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে।
জনকণ্ঠ: অনুপ্রেরণা কোথায় পেয়েছেন?
ইমন: আমরা দেখছিলাম সারাদেশে কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করলেই তাকে বিভিন্নভাবে জুলুমের স্বীকার হতে হয়। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতা ছিল না আমাদের। অন্যদিকে জনগণের সবথেকে আস্থার জায়গা গণমাধ্যমের উপরেও ছিলো তৎকালীন সময়ে এক কালো ছাঁয়া। তাই মনে হয়েছিল বহির্বিশ্বের মানুষ, মিডিয়া, সংস্থাগুলো জানুক আমাদের এই দেশের কি হাল।
সাংবাদিক, ছাত্র, শ্রমজীবী মানুষদের কি অবস্থা জানুক সকলে। এই অবস্থার বিরুদ্ধে কথা বললে আমরা পাবো কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা চর্চার ইচ্ছাই আমাদের মাত্র এবং একমাত্র অনুপ্রেরণা। তাছাড়া অধিকাংশ মেইলেরই ফিডব্যাক পেতাম আমরা। এতে করে কাজের আগ্রহ কারো বেড়ে যেত।
জনকণ্ঠ: কারা কারা কাজ করেছেন? কতজন কাজ করেছে?
ইমন: মূলত আমি নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তবে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম গঠন করে দেওয়ার পরে সবাই নিজ দায়িত্ব একেকজন লিডার হয়েই কাজ করেছে। আমি দেখেছি তাদের কাজ করতে পারার ক্ষমতা ও আগ্রহ ছিলো অতুলনীয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মারজান মেহেদী জয়ী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুমাইয়া হিয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসাদ জাহান, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পৃহা নৈঋত, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীফ ও তন্ময়, বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জনসহ আরো অনেকেই ছিলো যারা আমাদের সাথে কাজ করেছিল।
জনকণ্ঠ: আপনাদের এই নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা কী?
ইমন: আমাদের এই টিম আরো বড় করবো। দেশের সংকটপূর্ণ সময়ে আমরা আবারো কাজে নামার জন্য প্রস্তুত থাকবো। সাথে সোশাল মিডিয়ায় মাঝেমধ্যেই গুজব ছড়ানো হয়। সেটি বন্ধ করতেও আমরা কাজ শুরু করেছি। আশা রাখছি ভালোভাবেই আমাদের এই টিম কাজ করবে।
জনকণ্ঠ: এই কাজ নিয়ে আপনার অনুভূতি কী?
ইমন: কাজের সময় বিভিন্ন বাঁধা-বিপত্তি ছিল। নিজের ফোন নিয়ে আন্দোলনে যেতেই ভয় লাগতো। এই বুঝি আমার ফোন চেক করবে প্রশাসন আর আমার সাথে আমার সব টিম মেম্বাররাও গ্রেফতার হয়ে যাবে। নিজের ম্যাথ কোর্সের নাম দিয়ে সব গ্রুপগুলো খুলেছিলাম তাই। তবুও ভয় ছিলো টিম মেম্বারদের জন্য। ভয় ছিলো ‘আমরা থেমে গেলে কাজ করবে কারা?’। ভয় আর শঙ্কাই ছিল আন্দোলনকালীন অনুভূতি। আর এখনকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। দেশ ও জাতির জন্য কিছুটা হলেও করতে পেরে আমরা আনন্দিত।
জনকণ্ঠ: জনকণ্ঠের সঙ্গে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বারাত