‘স্যাকরার তাঁতী বাজার’
সোনা কিংবা রূপা নিয়ে চলে তাদের কর্মযজ্ঞ। সেই সুবাদে সোনা বা রূপার টুকরাটি মৃৎ পাত্রে রেখে সে কাজের সূচনা হয়। এরপর পিতলের ফুকনিতে ফুঁ দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় গলিয়ে নেন সেই ধাতবকে। নরম হয়ে যাওয়া টুকরোটিকে ছাঁচে ফেলে গড়ে নেন বৈচিত্র্যময় নকশার গহনা।
এভাবেই ধাপে ধাপে তৈরি হয় আঙুলের আংটি থেকে হাতের চুড়ি, গলার হার, কানের দুল, বাজুবন্দ, হাঁসুলি, সীতাপাট, কানপাশা, নোলক, নথ, নাকছাবিসহ অঙ্গসজ্জার নানা অনুষঙ্গ। পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারে ঢুঁ দিলে গয়না তৈরির এমন দৃশ্য নিত্যদিনই চোখে পড়ে। ঐতিহ্যের সাক্ষ্যবহ স্যাকরা কিংবা স্বর্ণকারদের সেই শিল্পিত কর্মতৎপরতাকে সঙ্গী করে দ্বীপ গ্যালারিতে শুরু হলো ভিন্নধর্মী এক প্রদর্শনী। লালমাটিয়ার প্রদর্শালয়টিতে চলছে স্যাকরার তাঁতী বাজার শীর্ষক শিল্পায়োজন। দীর্ঘ এক দশক তাঁতী বাজারের গয়নার কারিগরদের কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণের আলোকে সজ্জিত প্রদর্শনীটির কিউরেট করেছেন তাহমীনা শৈলী।
বৃহস্পতিবার বিকেলে এই প্রদর্শনীর সূচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবীণ গয়নাশিল্পীসহ উপস্থিত ছিলেন গয়নাপ্রেমী অনেকে। তাদের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়াসহ বিশিষ্টজনরাও। এসময় দ্বীপ গ্যালারির প্রধান সমন্বয়ক মনন মোর্শেদের বলেন, স্যাকরা শিল্পী সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন, আনন্দবেদনা, তাঁতী বাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবার-দাবার, জীবনশিল্পের বহুমাত্রিক উপাদান এবং পারিপাশির্^ক নানা অনালোকিত দিকে প্রথমবারের মতো আলো ফেলা হয়েছে এই প্রদর্শনীতে।
গ্যালারিতে প্রবেশ করতেই ভিন্ন এক অনুভূতি জাগে দর্শনার্থীর মনে। স্যাকরার ডেরার আবহ মেলে ধরেছে মেঝেতে বিছিয়ে রাখা কাঠের তৈরি সারি সারি ক্যাশবাকশো। তাতে রয়েছে লাল মলাটের হালখাতা। ধাতু কাটা, জোড়া লাগানো ও নকশা করার যন্ত্রপাতি। মাথার উপর ঝুলছে দুটি বৈদ্যুতিক বাতি। পাশেই মান্দাতা আমলের টিনের ট্রাংক। চারদিকে ধূপের গন্ধ। চোখে পড়ে শঙ্খ ও গণেশের মূর্তি। গয়না তৈরির নানা সরঞ্জাম। প্রতিটি বস্তুতেই লেগে আছে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ছাপ। দেখে মনে হয়, অলঙ্কারের কারিগরদের প্রতিদিনের কাজের জায়গা। এ যেন স্যাকরাদের তাঁতী বাজার। এছাড়াও প্রদর্শনীতে ভিডিওচিত্রের সঙ্গে ছবি ও লেখায় স্যাকরাদের যাপিত জীবনের আদ্যোপান্ত। তুলে ধরা হয়েছে তাঁতী বাজারের বিবিধ বিষয়। নানা ধাতু ও আঙ্গিকের গড়া গহনায় সজ্জিত হয়েছে পুরো গ্যালারি।
তাঁতী বাজারের স্যাকরাদের গড়া ঝকঝকে অলঙ্কারের আড়ালে রয়েছে তাদের সংগ্রামমুখর জীবন। বিশ্বায়নের পরিবর্তনশীল বাজারের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে তাদের এই শিল্পসংগ্রাম কাছে থেকে দেখছেন গহনাশিল্পী ও উদ্যোক্তা তাহমীনা শৈলী। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি সাজিয়েছেন এই প্রদর্শনী। ব্যাতিক্রমী এই প্রদর্শনী বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁতী বাজার শুরুতে ছিল একেবারেই আমার কাজের জায়গা। গয়না বানাই বলে দেশের এমাথা-সেমাথা ছুটে ছুটে কারিগরদের কাজ দেখা, নকশা নিয়ে স্যাকরার সাথে বিস্তর আলাপ শেষে গয়নাগুলি বানিয়ে নেয়া, দুপুরের ডাল-ভাত, চা-বেগুনি, সুখ-দুঃখের কথা, সব মিলেই গয়না তৈরির কাজ চলতে থাকে আমাদের।
রুটিন কাজের জীবনে অনেক পরে খেয়াল করলাম, ঢাকার ভেতর একমাত্র তাঁতী বাজার গেলেই মনটা মুহ‚র্তে শান্ত হয়ে যায়। অথচ তাঁতী বাজার শুনলেই ভীষণ ভীড়ের অনেক পুরনো গল্পবলা ঝলমলে এক পাড়া ভেসে ওঠে চোখে। সরু গলিতে ঠাসাঠাসি দোকান, তাতে ধুপধুনো, আগরবাতির মাখো মাখো হাওয়ায় মাতোয়ারা আমি ভাবতে থাকি এমন ছোট্ট স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরে কি করে ভরি ভরি সোনার গয়না সেজে উঠছে রোজ! সেই কৌতূহল ও অভিজ্ঞতাই মেলে ধরেছি এই প্রদর্শনীতে।
আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন বেলা চারটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
ফুয়াদ