ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

কারাগারে বসে যেভাবে লেখা হয়েছিল কবর নাটক

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ১৫:৪০, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩

কারাগারে বসে যেভাবে লেখা হয়েছিল কবর নাটক

আরণ্যক নাট্যদলের মঞ্চস্থ করা কবর নাটকের দৃশ্য 

বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে মুনীর চৌধুরীর লেখা কবর নাটকটি স্মরণীয় নাম। কারাগারের ভেতরে বসে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই নাটকটি যেভাবে লেখা এবং মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। সেই কবর নাটকের ৭০ বছর পূর্ণ হয়েছে।

'কবর' নাটকটি লেখা হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। রাতে কারাগারের বাতি নিভিয়ে দেয়া হলে লণ্ঠনের আলোয় সেই নাটকের প্রথম মঞ্চায়নও হয়েছিল ঢাকা কারাগারে।

তখন কারাগারে থাকা কমিউনিস্ট নেতা রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে ভাষা আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি কবর নাটক লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কারাবন্দি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। এটি ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশে মঞ্চায়িত হওয়া অন্যতম জনপ্রিয় নাটকে পরিণত হয়েছে। কবর নাটকের মঞ্চায়ন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহতদের মরদেহ পাকিস্তান সরকার গোপনে কবর দিতে চেয়েছিল। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটকের কাহিনী এগিয়েছে।

নাট্যকর্মীরা বলছেন, বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হওয়া এটাই প্রথম প্রতিবাদী নাটক।

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, নাটকটি মুনীর চৌধুরী লেখা শেষ করেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আর জেলখানায় অভিনীত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি।

যেভাবে লেখা হয়েছিল কবর নাটক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি প্রতিবাদ সভায় একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব পাস হয়। সেই কারণে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। সেই সময় একই কারাগারে অপর একটি কক্ষে বন্দী ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা রণেশ দাশগুপ্ত। একদিন রণেশ দাশগুপ্তের পক্ষ থেকে একটি গোপন চিঠি আসে মুনীর চৌধুরীর কাছে।

‘বাংলাদেশের নাট্যপ্রবাহ স্মরণীয় পদক্ষেপ’ বইতে সেই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ফারহানা আখতার। তিনি লিখেছেন, রণেশ দাশগুপ্ত নাট্যকারকে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটি নাটক লিখে দেয়ার জন্য বলেন, যা জেলখানায় অভিনীত হবে।

রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে মুনীর চৌধুরী তখন যে নাটকটি রচনা করেছিলেন, সেটি কবর।

সেখানে কবর নাটক লেখার পটভূমি প্রসঙ্গে রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে একটি নাটক অভিনয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা জেলে দুই নম্বর খাঁচায় আটক কমিউনিস্ট বন্দিরা। তারা অনুরোধ জানিয়েছিলেন, মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লিখে দিতে।

যেহেতু আমার সঙ্গে মুনীর চৌধুরীর একটা বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক ছিল বরাবরই, সেজন্য সকালের হয়ে আমি পুরানা হাজত হতে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলাম মুনীর চৌধুরীকে নাটক লিখে দেবার জন্য। মুনীর চৌধুরী তখন ঢাকা জেলের দেওয়ানি নামক ছোট ঘরটিতে আটক থাকতেন।

কারাগারের রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে কয়েক দিনের ভেতর নাটকটি লিখে ফেলেন কবীর চৌধুরী। এটি ছিল তার লেখা তৃতীয় নাটক। মঞ্চ নাটক নিয়ে ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘থিয়েটার’ প্রথম সংখ্যাটি মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। সেখানেই একটি নিবন্ধে এই তথ্য উল্লেখ করেন রণেশ দাশগুপ্ত।

বাংলাদেশের 'নাটক ও নাট্য দ্বন্দ্বের ইতিহাস' বইতে শান্তনু মজুমদার লিখেছেন, রাত দশটার পরে জেলের বাতি নিভিয়ে দেয়ার পর লণ্ঠনের আলোতে মঞ্চস্থ করার এবং নাটকটিতে মেয়ে চরিত্র এমনভাবে থাকে যেন পুরুষদের দ্বারা অভিনয় করা চলের শর্ত মেনেই তিনি তা রচনা করেছিলেন।

মঞ্চ নাটকের সঙ্গে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট থাকায় ছোট পরিসরে কীভাবে নাটকটি লিখলে মঞ্চস্থ করা সহজ হবে, সেটা মুনীর চৌধুরীর জানা ছিল। কারাগারের পরিবেশে অল্প কিছু অভিনয় শিল্পীর কথা মাথায় রেখে হ্যারিকেনের আলো আধারির পরিবেশে তিনি নাটকটি লেখেন।

কারাগারের ভেতর প্রথম সেই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন ফনী চক্রবর্ত্রী। মুনীর চৌধুরী অন্য কক্ষে ছিলেন বলে কবর নাটকের প্রথম অভিনয় দেখতে পারেননি। কবর নাটকের দৃশ্যরামেন্দু মজুমদার লিখেছেন, মুনীর চৌধুরী ভাবলেন, সেট ও আলোর ব্যবস্থা থাকবে না, তাই সেই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি নাটকের ঘটনাস্থল হিসেবে বেছে নিলেন গোরস্তানকে- যেখানে সেটের প্রয়োজন নেই।

"সময় শেষ রাত। নাটকের শুরুতেই নাট্যকারের নির্দেশ : মঞ্চে কোনোরূপ উজ্জ্বল আলো ব্যবহূত হইবে না। হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশকে সৃষ্টি করিতে হইবে। 

আমেরিকান নাট্যকার আরউইন শ’ এর লেখা ‘বেরি দ্যা ডেড’ নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটকটি লেখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। তবে সেখানে ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামের চিত্র সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, নাটকটি লেখার সময় এ রকম কোন বিষয় তার মাথায় ছিল না। কিন্তু অবচেতনভাবে হয়তো সেই ছায়া এসে থাকতে পারে।

শান্তনু মজুমদারের বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা যদি স্মরণ করি যে, নাট্যকার উল্লেখ করেছে, রচনার সময় এতটা সচেতন না থাকলেও পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ৪৩-৪৪ সালে আমেরিকার বেশ কিছু বামপন্থী সৈনিকের সঙ্গে কুর্মিটোলায় তার যে আলাপ হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ড. নরমান স্প্রিংগার যে তাকে আরউইন শ’র বেরি দ্যা ডেড নাটক পড়তে দিয়েছিলেন, তার প্রভাবও অবচেতনভাবে কবর-এ পড়েছে।...কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানোত্তর বিদ্যমান বাস্তবতাই ছিল এ নাটকের ভিত্তিভূমি।

কারাগারের বাইরে নাটকের মঞ্চায়ন
কারাগারের বাইরে কবর নাটক প্রথম মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়ন এবং সংস্কৃত সংসদের আয়োজনে সেই নাটকের রিহার্সাল দেখতে নিয়মিত আসতেন মুনীর চৌধুরী। নাটকটি মঞ্চায়নের খবর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়।

দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় বড় বড় হেডিং ও সাব-হেডিংসহ ছাপা হয়েছিল, গত ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কার্জন হলে কয়েক সহস্র শোকসন্তপ্ত মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকের সম্মুখে মুনীর চৌধুরী লিখিত কবর নাটক অভিনেয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফুটে উঠেছিল পুলিশ, মিলিটারি, বুলেট, সঙ্গিনের অত্যাচার জর্জরিত ঢাকার ছাত্র যুবকদের কথা, তাদের উপরকার ন্যায়নীতি বিসর্জিত হামলার ঘৃণ্য পাশবিকতার কথা।

‘পঞ্চাশ দশকের পত্র-পত্রিকায় ঢাকার নাটক’ বইয়ে লিখেছেন ওবায়দুল হক সরকার আরও উল্লেখ করেছেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রতিদিন রিহার্সালে আসতেন। কবর তখনও পর্যন্ত পাণ্ডুলিপিই ছিল।

মুনীর চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে শান্তনু মজুমদার উল্লেখ করেছেন, স্বয়ং নাট্যকার বলেছেন, কবর নাটকটিতে শুধুমাত্র একুশের তাৎপর্য খোঁজা হলে খানিকটা ভুলই বরং করা হবে, হয়তো আর বেশি কিছু বলার চেষ্টা করেছি আমি। আরও বেশি কিছু।

রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত বাংলাদেশে নাট্যচর্চার তিনদশক বইয়ে একটি নিবন্ধে আতাউর রহমান লিখেছেন, সার্বিক অর্থে আমাদের দেশে প্রথম প্রতিবাদী নাটক ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত মুনীর চৌধুরীর কবর।...একটি বিষয় এখানে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, লিখিত নাটকের গুণাগুণের বিচার হয় সে নাটকটির মঞ্চ সাফল্যের ওপর। এ ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর কবর একটি মঞ্চ সফল নাটক।

১৯৭২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি কবর নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল আরণ্যক নাট্যদল।

প্রতিষ্ঠাতা ও নাট্য-পরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, ভাষা আন্দোলনের ওপরে আমাদের তেমন কোন নাটক নেই বলা চলে। কিন্তু এটা তো আমাদের জাতির ইতিহাসের অন্যতম বড় ঘটনা। কবর নাটকটি দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে আমরা সরাসরি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।

অভিনয়ের দিক থেকে এবং মঞ্চে প্রায়োগিক দিক থেকেও  নাটকটি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। ভাষা আন্দোলনের বিষয়গুলো আমাদের কাছে এতো প্রাঞ্জল, এতো সহজভাবে চলে আসে, যে সেটা মঞ্চে সাফল্য নিয়ে আসে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসআর

×