সংগীত শিল্পী হুমায়ন কবির। ছবি: জনকণ্ঠ
তিনি দৃষ্টিহীন। চোখে দেখেন না। সবাই চিনেন হুমায়ন কবির নামেই। চলাফেরা একেবারেই সাদামাটা। গান শেখানোই তার পেশা। নেশাও বটে। তিনি নরসিংদী লালন একাডেমির সংগীত প্রশিক্ষক। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত সংগীত শিল্পী। মানুষকে সু পথে আনাই তার ধ্যান-জ্ঞান। গানের মধ্য দিয়েই এ কাজটি করে যাচ্ছেন দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে। নানা বয়সী শিষ্যদের আগমন তার ছোট বসত ঘরে। তারা ডাকেন ওস্তাদ জি।
তারই এক শিষ্য মাইনুদ্দীন। ওস্তাদ সম্পর্কে অনুভূতিটা এভাবেই ব্যক্ত করেন তিনি, হুমায়ন আমার গানের ওস্তাদ। এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার গুরু। ওনাকে আমি দীর্ঘ বিশ বছর যাবত চিনি। কঠিন অর্থনৈতিক টানাপোড়নেও গানকে আগলে রেখেছেন। হাল ছাড়তে দেখিনি।
আমাদের আলাপ শুরু হয়েছিল গান দিয়েই। তিনি গাইলেন নজরুল সংগীত।‘কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে, অতীত দিনের স্মৃতি, কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে, কেউ ভুলিতে গায় গীত।’ আমরা শুনলাম তার গান। বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মুগ্ধতায় হলাম আচ্ছন্ন। কিনা অপূর্ব মায়াময় রাত।
এই জীবনে কতটা মূল্যায়িত হলেন? হেসে বললেন, আমি দৃষ্টিহীন মানুষ। বুঝতেই পারছেন! আক্ষেপের সুরে আরও জানালেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেই ইচ্ছে আর বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) তালিকাভুক্ত শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। একবার চেষ্টাও করেছিলাম। মন্ত্রীর সুপারিশ না নিতে পারায় তালিকাভুক্ত হতে পারিনি।
অনেক আগে একবার বিটিভিতে বাংলার মুখ নামে একটা অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম। পল্লীগীতি নিজাম-উল-হকের কথা ও সুরে গান- ‘রিক্সাওয়ালা বলে- কারে তুমি আজ ঘৃণা করো। মুটে কুলি বলে- কারে তুমি আজ ঘৃণা করো। কিষাণ বলে- কেন হেলা করো। শ্রমিক বলে- কেন এড়িয়ে চলো।’
গানের রেশ কাটতে না কাটতেই নিচু কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, আমি ১৮ মাস বয়স থেকে দৃষ্টিহীন। পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় রূপ দেখার ক্ষমতা শিশু বয়সেই হারিয়ে ফেলি। গুটি বসন্ত- আমার চোখের আলো কেড়ে নেয়। দুই কবিরাজের দ্বন্দ্বে আমার চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে যায়। কথা শেষ না হতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন তিনি। আলতো করে মুছে নিলেন চোখ দুটি।
কী ই বা করার আছে, মনে কোন কষ্ট নেই। সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছা। সবই তকদির। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ আমার। সেই থেকে এখনো গানের সঙ্গেই আছি। ছোট বেলায় বড় দুলা ভাই মোনায়েম হোসেনই গান লিখে দিতেন। তিনিই আমার প্রথম ওস্তাদ। সেই গান রেডিও থেকে শুনে শুনে শিখে নিতাম।
হারমোনিয়াম ছাড়াও তিনি বাজাতে পারেন দুতারা, তবলা, মন্দিরা ও ঢোল। কীভাবে এত সব চর্চা করেন। সমস্যা হয়নি? সরল উত্তর- হাতের স্পর্শেই হারমোনিয়ামটা আয়ত্ত করে ফেলি। অন্যান্য যন্ত্রও এভাবেই শিখি। গানের জীবন শুরু করেন ৭৩ সালে। বলতে পারেন, গানের সঙ্গে আছি ৩২ বছর ধরে। শিষ্যদের নিয়ে বাড়িতেই গানের চর্চা করি।
জীবনের প্রয়োজনে ট্রেনে গান ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। সেই গল্পও করলেন, কী করব, বাঁচার তাগিদে ট্রেনে হকারিও করেছি। কখনো বই বিক্রি করেছি। কখনো কখনো যাত্রীদের গানও শুনিয়েছি। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা সব সময়ই খারাপ ছিল। এখনো যে খুব ভালো তা কিন্তু বলা যাবে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে সব সময়ই অবহেলিত ছিলাম। এখনো আছি। সামান্য সরকারি ভাতা ও গানের উর্পাজিত অর্থ দিয়েই চলে সংসার।
এই শিল্পী মানুষের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন। নরসিংদী সদরের ভেলানগর গ্রামে। সামান্য পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর মিরপুরে অন্ধ সরকারি বিদ্যালয়ে। বর্তমানে বসবাস করেন টাওয়াদী গ্রামে। তার ঝুঁলিতে আছে কিছু প্রাপ্তিও। পেয়েছেন জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা। গানের জন্য নরসিংদী জেলা প্রশাসন থেকে পেয়েছেন প্রশংসাপত্র।
তিনি বৈরাগ্য জীবন ধারণ করেননি। সমাজের অন্য আট-দশ মানুষের মতো তিনিও সংসার সাজিয়েছেন। তেল নুনের যোগান দিয়েছেন। বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলেন ১৯৮৯ সালের ১৬ জুলাই। বর্তমানে পাঁচ সন্তানের পিতা তিনি।
রাত বাড়ছে। আমাদের ফেরার তাড়া। স্মিত হেসে আমাদের বিদায় জানালেন। ফেরার মুহূর্তে দেখলাম, সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেলেন। বসলেন গিয়ে অপেক্ষারত ভক্তদের সঙ্গে। ফের সুর ধরলেন লালনের গানে- ‘আমার মন-চোরারে কোথা পাই, কোথা যাই, মন আজ কিসে বুঝাই, নিষ্কলঙ্ক ছিলাম ঘরে, কিবা রূপ নয়নে হেরে, মনে তো আমার ধৈর্য নাই।’
এসআর