ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

হুমায়ূণ ফরীদির অজানা কিছু ঘটনা

গৌতম পাণ্ডে

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

হুমায়ূণ ফরীদির অজানা কিছু ঘটনা

‘যারা আমারে আইজ চিনে নাই কাইল চিনবো, কাইল চিনে নাই পরশু চিনবো, চিনতেই হইবো। নাম আমার রমজান আলী!’ নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে অনেকের ভাবনার বারান্দায় অতীতের চিরচেনা কানকাটা রমজান চরিত্রের সেই কুটিল ব্যক্তির ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে! এক সময় বিটিভিতে প্রচারিত শহীদুল্লাহ কায়সারের বহুল আলোচিত নাটক ‘সংশপ্তক’। এ নাটকে রমজান আলী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। সেই নাটকে নষ্টা ও সমাজচ্যুত হুরমতি চরিত্রের ফেরদৌসী মজুমদারের হাতে নাজেহাল হয়ে কান বিসর্জন দিয়েছিলেন! তিনি হুমায়ুন ফরীদি। এদেশের মঞ্চ, টিভিনাট্য কিংবা চলচ্চিত্র ইতিহাসে চিরভাস্বর এবং অবিসংবাদিত অভিনেতা। বিটিভির যুগে কানকাটা রমজানরূপী হুমায়ূন ফরিদীর তখন থেকেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠার শুরু! অভিনয়জীবনে একের পর এক মুগ্ধকর চরিত্রে অভিনয়ে তিনি সত্যিই তাকে চিনতে বাধ্য করিয়েছিলেন সবাইকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অন্তরে তার নাম লিখিয়েছেন ভালোবাসার অক্ষরে। যদিও মরণোত্তর পেয়েছেন একুশে পদক। তবে সংশপ্তক নাটক প্রচারের অনেক আগে থেকেই হুমায়ুন ফরীদি মঞ্চ এবং টিভি নাটকের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা ছিলেন। এই নাটকটিকে তার শ্রেষ্ঠ কাজও বলা যায় না। তবুও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে বেশির ভাগ মানুষই বোধহয় কানকাটা রমজানকেই পছন্দ করবেন।

হুমায়ূন ফরীদির জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে এ লেখা যা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা, আবার অনেকে জেনেও থাকতে পারেন। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি শতকোটি ভক্তকে বেদনার সাগরে ডুবিয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। জীবনভর শুধু অভিনয়ই করে গেছেন। নিজেই বলতেন, অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারি না আমি। ভীষণ কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। জানা যায়, অভিনয়জীবনের মতোই জীবনাচারেও ফরীদি ছিলেন সাবলীল-স্বতঃস্ফূর্ত। বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এ আয়োজন।

হুমায়ুণ ফরিদী তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে স্থাপিত হওয়া একটি হলের নাম ছিল আল বিরুনি হল। রোদ-বৃষ্টির কারণে মুছে গিয়েছে আল বিরুনি, আছে শুধু হল! ছাত্রদের অনুরোধেও কতৃপক্ষ যখন নতুন করে হলের নাম আর লেখার প্রয়োজন মনে করে নাই। তখন ফরীদি গভীর রাতে গিয়ে একটি অদ্ভুত কাজ করলেন। পরের দিন সকালে সবাই দেখল, হলের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে হুমায়ুন ফরীদি হল। উপরের মহল তো রেগেই আগুন! কে করেছে এই কাজ? ফরীদিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নির্লিপ্ত গলায় বললেন-আপনারা তো ঠিক করলেন না, তাই আমিই ঠিক করে দিলাম! ফলাফল-এরপরেই হলের নাম ঠিক করে আবার আল বিরুনি হল রাখা হলো!

এক কুরবানি ঈদের সময় হলের বেশিরভাগ ছাত্ররা বাড়িতে চলে গেছে। অল্প কয়েকজন হলে থেকে গেছে, কারণ ঈদের পরেই পরীক্ষা। এই ছাত্ররা মিলে মরহুম প্রফেসর কলিমুল্লাহর স্যারের কাছে একটি গরুর আবদার করেন ঈদ উপলক্ষে। স্যার বললেন, তোমরা কয়জন? আমরা ২০- ২২ জনের মত আছি স্যার- উত্তর এলো। তাহলে তোমাদের গরু লাগবে না, এক কাজ করো, আমি খাসির ব্যবস্থা করছি তোমাদের জন্য। কষ্ট পেয়ে ছাত্ররা স্যারের বাসা ত্যাগ করল। সেই রাতেই স্যারের কোরবাণীর গরু ফরীদির ইসারাতেই চুরি করে তারা পরের দিন সাভার থেকে কসাইকে এনে কোরবাণী দেয়। দেড় মণের মত মাংস হলো, ফরীদি কসাইকে বললেন ১৫ কেজির মতো রান্না করেন আর বাকিটা রেখে দেন। এদিকে কলিমুল্লাহ স্যার সকাল বেলায় নিজের গরুকে না পেয়ে! উপায় না দেখে সকালেই নয়ারহাট (সাভারের একটি বিখ্যাত বাজার এলাকা) থেকে গরু কিনে আনলেন, আর হলের ছেলেদের কাছে খবর পাঠালেন ‘তোমরা আমার বাসায় এসে সেমাই খেয়ে যেয়ো’। সেমাই খেতে যাওয়া বালকেরা খালি হাতে গেল না, বেঁচে যাওয়া গরুর মাংস সব নিয়ে গেল স্যারের বাসায়। স্যার বললেন, এগুলা কি? ফরীদি মুচকি হেসে বললেন, আমরা স্যার একটা গরু কিনেছিলাম, আমাদের খাওয়া শেষ, তাই ভাবলাম বাকিটা আপনার জন্য নিয়ে আসি। স্যার সব বুঝে গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ! বুঝলাম! রাখো এই মাংস, আর খেতে বসো!

ফরীদির এক সহপাঠী অর্থনীতি বিভাগের নূরুল ইসলাম পাশ করে বেরিয়ে গিয়ে সেই বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলেন। একদিন নূরুল স্যার ক্লাস নিতে আসলেন, বোর্ডে বেশ কিছু লিখে ছাত্রদের বোঝার সময় দেয়ার জন্য থামলেন। হঠাৎ কে জানি একজন বলে উঠল-এই নুরুল! তিন নাম্বার লাইনের একদম বাম দিকে ঐটা কি লিখছিস, একটু বুঝিয়ে বল তো! পুরা ক্লাস চুপ, স্যার অবাক! স্যার ভাবছেন-আমাকে নুরুল বলে ডাকার দুঃসাহস কার এই ক্লাসে? ক্লাসের একজন বাদে বাকি সব ছাত্ররাও একই কথা ভাবছে! হঠাৎ সেই দুঃসাহসী ব্যক্তিকে দেখা গেল, এই যে নুরুল, আমি এইদিকে, আরে এই দিকে! কীরে? চিনতে পারছিস না আমাকে? আরে আমি ফরীদি! তোর সাথে না পড়তাম? ভুলে গেলি পাশ করেই? হা করে তাকিয়ে না থেকে তিন নাম্বার লাইনের একদম বামে কি লিখেছিস আমাকে দয়া করে বুঝিয়ে দে! পাশ তো করতে হবে নাকি?

শীতের সময় হুমায়ুন ফরীদি অনেক রাতে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছেন। বিজয় সরণি মোড় পার হবেন, তখনই একটি দৃশ্য দেখে গাড়ি থামালেন। দেখলেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, তার পড়নে লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নাই। হুমায়ুন ফরীদি নিজের কোট আর শার্ট খুলে ঐ বৃদ্ধকে পরিয়ে দিয়ে আসলেন, বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। ফরীদি বাসায় ফিরলেন খালি গায়ে। এটা তো শুধু একটা উদাহরণ, সাভারে দুইটি এতিমখানা আছে যার যাবতীয় খরচ ফরীদি বহন করতেন, কেউই জানতো না যে ফরীদি দুইটি এতিমখানা চালাচ্ছেন। নিজের দানের কথা জানাতে বিরক্ত বোধ করতেন তিনি।

ফোন রিসিভ করার পরে আমরা সবাই সাধারণত প্রথমে হ্যালো বলি, কিন্তু ফরীদি হ্যালো বলতেন না। তিনি কেমন আছ? বলে কথা শুরু করতেন। অপরিচিত নাম্বারের বেলায় তিনি কি করতেন, তা আমার জানা নেই!
একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় নাটক ভোলার ডায়রি খ্যাত অভিনেতা সাজু খাদেম হুমায়ুন ফরীদিকে এতটাই নিখুঁতভাবে নকল করতে পারতেন যে, একটা সময় বিরক্ত হয়ে ফরীদি সব জায়গায় ফোন করে বলতেন, হ্যাঁ, আমি সাজু খাদেম না, আমি আসলেই হুমায়ুন ফরীদি, আমি সত্যি বলছি!

সুবর্ণা মুস্তফার সাথে একবার তার প্রচণ্ড ঝগড়া হলো, রাগ করে সুবর্ণা অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে শুয়ে পড়লেন। সকালে উঠে দরজা খুলে দেখেন, যেই রুমে ঝগড়া হয়েছিল, সেই রুমের মেঝে থেকে ছাদের দেয়াল পর্যন্ত একটি কথাই লিখে পুরো রুমকে ভরে ফেলা হয়েছে, কথাটি হল-সুবর্ণা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এত ভালোবাসাও তাদের বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারেনি, ২০০৮ সালে ডিভোর্স হয় তাদের। এক ইন্টারভিউতে ফরীদিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনারা আলাদা হয়ে গেলেন কেন? উত্তরে বলেছিলেন, এটা তোমার সুবর্ণাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমি তো সুবর্ণাকে ছাড়িনি। ও আমাকে ছেড়েছে।

×