ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৬ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১

রাকিবুল হাসানের চলচ্চিত্র ’ছোঁয়া’ নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সন্ধান দিবে

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ৩ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ১৩:০৭, ৪ জুলাই ২০২৪

রাকিবুল হাসানের চলচ্চিত্র ’ছোঁয়া’ নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সন্ধান দিবে

তিনি সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন বহু চলচ্চিত্র। এছাড়াও চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ান পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ

রাকিবুল হাসান চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক ধরে। এই সময়ে তিনি নির্মাণ করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য চলচ্চিত্রসহ টেলিভিশনের জন্য অর্ধ শতাধিক নাটক, টেলিফিল্ম ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন এক যুগ ধরে। তিনি সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন বহু চলচ্চিত্র। এছাড়াও চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ান বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটসহ বহু প্রতিষ্ঠানে। চলচ্চিত্র শিল্পে অবদানের জন্য ২০২৩ সালে পেয়েছেন 'ঋত্বিক সম্মাননা পদক'।সম্প্রতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'ছোঁয়া' নির্মাণের জন্য তিনি সরকারী অনুদান পেয়েছেন । 'ছোঁয়া' তাঁর চতুর্থ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ওবায়েদ হকের একাধিক গল্প অবলম্বনে নির্মিতব্য চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখেছেন রাকিবুল হাসান নিজেই। 'ছোঁয়া' চলচ্চিত্রটিতে দেখা যাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় একটা অনগ্রসর কমিউনিটির সংগ্রামের একটি মর্মস্পর্শী চিত্র। চরিত্রদের ব্যক্তিগত গল্পের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে বাস্তববাদের গভীর অনুভূতির সাথে তুলে ধরা হবে। ‘ছোঁয়া’ চলচ্চিত্রটির গল্পের সূচনা হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, যার চুড়ান্ত পরিণতি ঘটে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে; ‘কোভিড-১৯’ দুর্যোগের শেষ দিকে ১৯২২ সালের ২৬ মার্চ। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা জানবে, মুক্তিযুদ্ধ শুধু আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীটাই করেনি, এই যুদ্ধে আত্মত্যাগ রয়েছে সকল শ্রেণী-সকল পেশার মানুষের।

রাকিবুল হাসানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'লিলিপুটরা বড় হবে'র বিষয়ও ছিল শ্রেণীবৈষম্য। ওই চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই, নিম্নবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি করিম স্যার একটা স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। তিনি ছাত্রদের গালিভার ট্র্যাভেলস পড়ান। তিনি ছাত্রদের বলেন, গল্পের চরিত্রগুলি রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। 'লিলিপুট'রা নিম্নবিত্ত শ্রেণী, ব্রবডিংনাগরা উচ্চবিত্ত এবং মাঝামাঝি আকৃতির গালিভার আসলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতীক। গল্পটিতে ব্রবডিংনাগদের ভয়ে গালিভার আদতে লিলিপুটদের কোনও উপকারে আসেন না একদিন স্যারের ছেলে অরুপকে উচ্চবিত্ত আফতাব মোল্লা গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেন। করিম স্যার তাঁর ছেলে হত্যার বিচারের আশায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাহায্য চান। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিরা করিম স্যারের পাশে থাকতে চান কিন্তু  আফতাব মোল্লাকেও তারা ভয় পান। ফলে, ওরা করিম স্যারের কোনও কাজে আসেন না। একটা সময় করিম স্যারের বোধোদয় হয়, লিলিপুটদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য, সমাজের গালিভারদের সাহায্য পাওয়া যাবে না। লিলিপুটদের নিজেদেরই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, বড় হতে হবে। লিলিপুটরা সত্যিই একদিন বড় হবে -এই প্রত্যাশা রেখেই চলচ্চিত্রটি শেষ হয়। 

রাকিবুল হাসানের সবক'টি চলচ্চিত্রের বিষয় ভিন্নধর্মী। যে কথা কেউ বলে না সেই অকথিত বিষয়গুলোকেই তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন। 'হিল্লা' চলচ্চিত্রেও তিনি প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। ইসলামে কোনও স্বামী তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর যদি আবার সেই স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চায় তাহলে স্ত্রীকে আরেকজনের সাথে 'হিল্লা' বিয়ে দিতে হয়। এই 'হিল্লা' বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন হাদিসের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন রয়েছে। তাহলে, একজন মুসলিম কোন হাদিসটা গ্রহণ করবে? -এই প্রশ্নটা রাখা হয়েছে 'হিল্লা' চলচ্চিত্রে।

তাঁর 'নারী' চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছিল শরীয়া আইনের কুফলগুলো। দেশে যখন জঙ্গিবাদ বেড়ে গিয়েছিলো এবং জঙ্গিরা দেশে শরীয়া আইন চালুর দাবি তুলছিল তখনই তিনি এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন। ধর্মের নামে ক্ষতিকর কিছু করা হলেও কেউ প্রশ্ন তুলতে চান না। তিনি কেন এগিয়ে আসেন? -এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'দেখুন, আমার পায়ে ঘা হলে আমি যদি চিকিৎসা না করে তা ঢেকে রাখি তাহলে পায়ে পচন ধরে গ্যাংরিন হতে পারে। এমন কী, একসময় আমার পা কেটে ফেলতে হতে পারে। তাই, ঘা কে আমি প্রকাশ্যে আনতে চাই, যেনও সবাই ভাবতে পারে- এর চিকিৎসা দরকার।'

চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি রাকিবুল হাসান সিনেমাটোগ্রাফিও করেন। এর মধ্যে জাহিদ হোসেন পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'সুবর্ণভূমি' শেষ করেছেন, আগস্ট থেকে তাঁরই আরেকটা চলচ্চিত্র 'লীলামন্থন'-এ সিনেমাটোগ্রাফি করবেন। ২০২৫-এর শুরুতে সিনেমাটোগ্রাফি করবেন তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' চলচ্চিত্রে। 

তাহলে 'ছোঁয়া'র শুটিং কবে শুরু হবে? -এই প্রশ্নের উত্তরে রাকিবুল হাসান বলেন, 'ছোঁয়া'; ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকাল এবং ২০২২-২৩-এর কোভিড দুর্যোগকাল-এই দুই সময়ের গল্প। এই চলচ্চিত্রের সেটিংস হবে দুই ধরণের। তাই, আমি শুটিং করব দুই পার্টে। প্রথম পার্টের শুটিং নভেম্বরে শুরু করার কথা ভাবছি, দ্বিতীয় পার্ট ২০২৫-এ। 

'ছোঁয়া' চলচ্চিত্র থেকে দর্শক কী পাবে? -এ ব্যাপারে রাকিবুল হাসান বলেন, 'ছোঁয়া' চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সেই সময়ের ত্যাগ ও সংগ্রামের গল্প উঠে আসবে। এটি দর্শকদের মধ্যে ইতিহাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করবে। "ছোঁয়া" চলচ্চিত্রটি দর্শকদের মনস্তত্বে একটি গভীর এবং স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। এটি শুধু একটি আবেগময় কাহিনী নয়, বরং একটি শিক্ষা, অনুপ্রেরণা এবং মানবিকতার প্রতীক হয়ে উঠবে। 'ছোঁয়া' চলচ্চিত্রটি দর্শকদের হৃদয়ে মমতা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করবে, যা তাঁদের জীবনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে বলে আমি আশাবাদী।রাকিবুল হাসানের চলচ্চিত্র মানেই ভিন্নধর্মী গল্প, শৈল্পিক চিত্রায়ণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের একটি অন্বেষণ। 'ছোঁয়া' প্রসঙ্গে তিনি জানান, এই চলচ্চিত্রটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনের মাধমে এই প্রজন্মের দর্শকের কাছে নিয়ে আসবে, যেনও এই প্রজন্ম এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পরে।
 

তাসমিম

×