ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুধু নির্বাক স্মৃতি ॥ কল্যাণী ঘোষ

গৌতম পাণ্ডে

প্রকাশিত: ২১:০৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুধু নির্বাক স্মৃতি ॥ কল্যাণী ঘোষ

কল্যাণী ঘোষ

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শিল্পী কল্যাণী ঘোষ। জন্ম থেকেই পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন। সংগীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন কিছু সংগঠনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষকে। সে সময়ের কিছু স্মৃতিময় ঘটনাবলি সম্পর্কে কথা হয় গুণী এই শব্দসৈনিকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গৌতম পাণ্ডে।
আপনার দেখা মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বলুন
আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের সেই সব স্মৃতিময় দিনগুলো এখন ধূসর হয়ে এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুধু নির্বাক স্মৃতি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর চট্টগ্রামের অনেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ২৩ মার্চ সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যোগ দিয়েছিলাম। ২৬ মার্চের রাতে পাক বাহিনীরা গোলাগুলি শুরু করল। ২৮ মার্চ পর্যন্ত শহরে থাকার পর আমি মা-বাবা আমার ভাই প্রবাল, বোন উমাসহ সবাই চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি রাউজানের বীনাজুড়িতে। রাজাকারদের অত্যাচারে সেখানে ১৫ দিনের বেশি থাকতে পারিনি।

বোরখা জোগাড় করে মুখে কালি মেখে আমার দুই বছরেরও ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বৃষ্টি ও বারবার বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে রাতে রামগড়ের কাছে পৌঁছলাম। রামগড়ের বর্ডার পার হয়ে ওপারের ত্রিপুরার সাবরুম নদীতে জল কম থাকায় হেঁটে পার হলাম। ওপার পার হওয়ার পর দেখলাম শরণার্থী অনেকের কলেরা দেখা দিয়েছে। কয়েকটি ট্রাক দাঁড় করানো ছিল, তার নিচে রাত কাটিয়ে ভোরে বাসে করে আগরতলায় পৌঁছলাম। আমার বোন উমার বসন্ত হওয়ার কারণে সেখানে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো। ৫ মে আমরা কলকাতা পৌঁছলাম।
কিভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যোগ দিলেন?
আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে আমার মা লীলাবতী চৌধুরীর কাছে গান শেখা শুরু করি। চট্টগ্রাম বেতারে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে আমি প্রথম গান করি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেখানের সব রকম গানের আয়োজন আমিই করতাম। সে কারণে সবাই আমাকে চিনত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় গেলাম তখন অনেক গুণী ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেখানকার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আমি, আমার ভাই প্রবাল ও উমা গান করেছিলাম। এ সময় দেখা হয়েছিল ড. সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে। আমার গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। সেখানে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, জহির রায়হান, মোস্তফা মনোয়ার, ভারতের দীপেন বন্দোপাধ্যায়সহ অনেকে। আমাদের ওনারা দলে নিয়ে নিলেন। আমরা ‘রূপান্তরের গান’ নামক গীতিনাট্যে গাইতাম। পরে এর নাম হয় ‘মুক্তির গান’। আমরা এটা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশন করতাম। জুনের প্রথম দিকে গড়িয়া হাটের মোড়ে সুরকার সমর দাস ও শিল্পী আবদুল জব্বারের সঙ্গে দেখা হয়। তারা আমাদের চিনতেন। ওনারাই আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে আপনাদের কার্যক্রম কি ছিল?
কেন্দ্রটি ছিল কলকাতা ১৯-এর ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে নিয়মিত গান রচনা, সুর ও রেকর্ড হতো এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচার হতো। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি গান শেখানো হতো এবং তার রেকর্ডিংও হতো। আমরা পঞ্চাশটিরও বেশি গান করেছি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। বেশিরভাগ গান ছিল সমবেত। এ ছাড়া একক ও দ্বৈত গানও হতো। আমি আর প্রবাল ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি পূণ্য সলীলে’ গানটি দ্বৈত রেকর্ড করেছিলাম। গানটি লিখেছিলেন বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় আর সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব’ গানটি রেকর্ড করেছিলাম আমরা তিন ভাই বোন। এটির সুর করেছিলেন সমর দাস।
শুনেছি আপনিও একটি সংগঠন করেছিলেন
এরই মধ্যে আমরা ২৬ জন মিলে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম, এর সেক্রেটারি ছিলাম আমি। এ সংগঠনের হয়ে ‘একটি সূর্যের জন্ম’ নামে একটি আলেখ্য পরিবেশন করতাম। ১৯৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনার ইতিবৃত্ত নিয়ে আলেখ্যটি রচনা করেছিলেন মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাঠও করতে তিনি। এ ছাড়া গণসংগীত ও বিভিন্ন রকমের গান পরিবেশন করতাম।

×