লিয়াকত আলী লাকি
লিয়াকত আলী লাকি। একাধারে তিনি নাট্যাভিনেতা, নাট্যনির্দেশক, নাট্যকার, সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। ১৯৮১ সালের ৬ জুলাই লোক নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আজ অবধি তিনি লোক নাট্যদলের অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আনন্দকণ্ঠের সঙ্গে সমসাময়িক নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- এন আই বুলবুল
শোকের মাসে শিল্পকলার আয়োজন নিয়ে জানতে চাই?
যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি হতো না। এই আগস্ট মাসে সেই জাতীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই আগস্ট আমাদের জন্য বেদনাদায়ক। শোকাবহ আগস্ট হিসেবে মাসব্যাপী আমরা শিল্পকলায় অনুষ্ঠান করছি। তবে শোক থেকে আমরা নতুন একটি স্লোগান নিয়েছি। ‘শোক থেকে শক্তির অভ্যুদয়’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দীর্ঘ প্রত্যয়। জাতীর পিতার যে স্বপ্ন সেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। একইসঙ্গে বলতে হয় শিল্পকলা একাডেমিতে আমার যে দায়িত্ব, সেখান থেকে একটি বড় দায়িত্ব পালন করেছি ‘শিল্পের আলোয় বঙ্গবন্ধু’। বিশ্বে অনেক মহান নেতা আছেন।
কিন্তু তাদের ওপর এত শিল্প সাহিত্য রচিত হয়নি। যেটি বঙ্গবন্ধুর ওপর হয়েছে। আমরা সত্য, সুন্দর ও কল্যাণে বিশ্বাসী। এটা আমাদের সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। সেই কাজটি করার জন্য ‘শিল্পের আলোয় বঙ্গবন্ধু’। জাতীর পিতাকে নিয়ে যত গান-কবিতা সহিত্য হয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া আমি মনে করি অন্যান্য সংগঠনের মতো, রাজনীতির মতো, সামাজিক সংগঠনের মতো বাংলাদেশ শিল্পকলারও অন্যতম দায়িত্ব বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করা।
জাতির পিতাকে হত্যাকা-ের পর আপনি প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই সময়টা নিয়ে বলুন?
শৈশব থেকেই সামাজিক, সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে আমি সচেতনতার জায়গায় ছিলাম। আমার পরিবার রাজনৈতিক পরিবার। আমার বড় ভাই ৭০ এ গনপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমি নিজেও ছাত্র জীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। পরবর্তীতে আমি ডাকসুতে সংস্কৃতি সম্পাদক নির্বাচিত হই।
জাতীর পিতার হত্যাকান্ডের পর আমার উপলব্দী হলে আমরা ৫শ বছর পিছিয়ে গেলাম। আমি অনুভব করি, এটার পতিবাদ কার উচিৎ। কিন্তু করব কিভাবে? তখন এটার জন্য অন্যতম অস্ত্র হিসেবে গানকে আমি বেচে নিই। পরিবেশ বুঝে আমি ভুপেন হাজারিকার দুটি গানের পর একটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করতাম। ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তখন যা আসতো তাই লিখেছি সুর করেছি ও গেয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমি প্রথম লিখেছি ‘দুখিনি বাংলা জননী বাংলা আজ কেঁদে কেঁদে কয়, আমার মুজিব কোথায়’ গানটি। মহাদেব সাহার ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’ কবিতাকে গানে রুপান্তর করেছি। ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মজিবুর রহমান’ এটিকে সুর করে গান তৈরি করি। এভাবে অনেকের গান কবিতাকে সুর দিয়েছি একইসঙ্গে গেয়েছি। এভাবেই আমি সেই সময় গানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি। এটি একটি ইতিহাস হয়ে গেছে।কিশোর বয়সে যুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?
আমার ভাই গণপরিষদের সদস্য হওযায় আমাদের বাড়ি থেকেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। আমার বড় ভাইয়েরা সেই সময় ভারতে চলে যান। আমাকে না যাবার জন্য বলে গেছেন। কারণ আমিও চলে গেলে পরিবার একটা সংকটে পড়ে যাবে। এরমধ্যে এপ্রিল মাস থেকে আমরা বাড়ি ছাড়া হয়ে যাই। কারণ তখন সংসদ সদস্যদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। সে সময় বিভিন্ন জায়গায় আমরা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থাকতাম। এ সময়ে আমি চারবন্ধু মিলে ভারতে চারবার পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। তবে ভারতে ট্রেনিং নেওয়া সম্ভব না হলেও স্থানীয়ভাবে আমরা একজন ইপিআরের কাছে সাতদিন ট্রেনিং নিলাম। এরপর স্থানীয়ভাবে যুদ্ধ শুরু করি। আমার পুরো একটি টিম ছিল। সেই সময় আমি গণসংগীতও করতাম সবাইকে যুদ্ধে অনুপ্রানিত করার জন্য।
যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করলেন তার কতটুকু পূরণ হয়েছে মনে করেন?
আমাদের স্বপ্ন পুরন হবেনা সেটি ৭৫ই বলে দিল। স্বপ্ন বাস্তবায়ন যিনি করবেন তাকেতো সোনার বাংলা গড়ে তোলার সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। জাতীর পিতা শুন্য হাতে একটা দেশ গড়তে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী কোনো জাতী ১০/২০ বছরে সুন্দর ভাবে দাঁড়াতে পেরেছে এমন ইতিহাস নেই। স্বপ্নের বাস্তবায়ন মাঝে ২১ বছর ঘটানোর কোনো সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো পরে আবার চলে গেল। তারপর ওয়ান ইলেভেন। এসবে তো স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় না। ২০০৯ সালে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে জার্নি শুরু করেছেন তা কত দ্রত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখে বিশ্ব বিস্ময় প্রকাশ করছে। প্রধানমন্ত্রীকে এশিয়ার লৌহমানবও বলা হয়।
আমরা তাকে বলছি উন্নয়নের মহাকবি, বিশ্ব বলছে মানবতার মা। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন পাকিস্তানকে সুইজারল্যান্ডের মতো করে দেবেন। তখন সাংবাদিকরা বলেছিলেন সুইজারল্যান্ড তো অনেক দূরে আপাতত আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দেন। কেন বাংলাদেশ এগিয়ে গেল তার জন্য তারা বলেছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রির কথা। নারীর ক্ষমতায়ন, অসম্প্রাদায়িক দর্শন প্রতিষ্ঠা তিনি করছেন। আমি মনে করি যদি আমাদের বর্তমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নষ্ট না হয় তাহলে ২০৪১ সাল আমাদের জন্য মাইলফলক হবে। আমরা উন্নত দেশ হবো, স্মার্ট দেশ হবো।
দীর্ঘ সময় শিল্পকলার মহাপরিচালক পদে আছেন। এ সময়ের জার্নিটা কেমন?
প্রথম কথা হলো, কেন বঙ্গবন্ধু শিল্পকলা নির্মাণ করেছেন সেটি আবিষ্কার আমি করেছি। আমাদের শিল্পকলা একাডেমিকে জেলা থেকে উপজেলায় সম্পসারিত করেছি। আমরা প্রত্যেক জেলায় পাঁচজনশিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করছি। অর্থ্যাৎ প্রতি বছর ৩২০জন শিল্পীকে শিল্পকলা থেকে সম্মননা প্রদান করছি। ২০১৩ সাল থেকে এটি শুরু করেছি। আমি শিল্পকলা পদক চালু করেছি। এটি আগে ছিল না। আমরা দশজন শিল্পীকে এ পদক দিই। ‘কোনো কিছু হারিয়ে যেতে দেব না’ এ প্রত্যয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা একসঙ্গে প্রায় সাড়ে তের হাজার গান সংগ্রহ করেছি। এটি আমাদের ও ন্যাশনাল আর্কাইভে আছে। ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর ৬৪ জেলায় একটি করে নাটক করছি।
এছাড়া এরমধ্যে আমরা যাত্রাপালাকে প্রশাসন মুক্ত করে আমাদের অন্তভূক্ত করেছি। আমাদের সঙ্গে প্রায় দু’শ যাত্রা দল আছে। তাদের আমরা সহযোগীতা করছি। সারাদেশে ১শটা যাত্রা দল নিয়ে আমরা যাত্রা উৎসব করেছি। ৭৫টি নৃত্যদল নিয়ে নৃত্যউৎসব করেছি। শিল্পের সব শাখাকে প্রসারিত করা আমাদের মূল লক্ষ্য। শিল্পকলায় চলচ্চিত্র বিভাগ ছিল আগে থেকে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এখন সেটি নিয়ে কাজ করছি। আমরা প্রতি বছর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব, স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব, শিশু চলচ্চিত্র উৎসব করছি। চলচ্চিত্র সংসদ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। নিয়মিত সেখানে চলচ্চিত্র প্রর্দশন হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে আমরা চলচ্চিত্রের সঙ্গে আছি।
৬৪ জেলায় কেউ ভালো সিনেমা প্রদর্শন করতে চায়লে আমরা সেটি কোনো টাকা ছাড়ায় হল দিচ্ছি। আমরা সংস্কৃতি মনিণি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ থেকে শুরু করে লালন সাঁইজি, এস এম সুলতান শচীন দেব বর্মন ও সুচিত্রা সেন পর্যন্ত তাদের জন্ম যেখানে হয়েছে সেখানে আমরা কালসারাল সেন্টার করবো। আন্তজার্তিকভাবেও আমরা বড় একটি অর্জনের দিকে যাচ্ছি। বাংলাদেশ শিল্পের ক্ষেত্রে একটা রেনেসা ঘটাচ্ছে এটি এখন বিশ্বের অনেকেই বলে থাকেন।
টানা কয়েকবার শিল্পকলার মহাপরিচালক পদে আছেন। এ কারণে আপনাকে নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন শোনা যায়। আপনি কি বলবেন?
এখানের দায়িত্বটা দেখেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তারা যদি মনে করেন এখানে কাউকে একবারের বেশি রাখবেন না তখন তিনি একবারই থাকছেন। যারা এ পদে কাউকে দিচ্ছেন তারা হয়তো মনে করছেন বঙ্গবন্ধুর শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে যে স্বপ্ন ছিল তা পূরণের জন্য আমাকে দরকার।
সিদ্ধান্ততো আমার না, আমি কেন এখানে আছি? আমি মনে করি আমার সমালোচনা হওয়া উচিত সেটি নিয়ে, যে আমি যথাযথভাবে কাজটি করতে পারছি কিনা। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পালন করতে পারছি কিনা? এটা নিয়ে যদি সমালোচনা হয় তাহলে আমি স্যালুড দেব। শিল্পকলা একাডেমি আজ ১২ বছরে যেখানে এসেছে সেটি দেখে বিশ্বের অনেক শিল্পী বিস্ময় প্রকাশ করেন। আমি দারুণভাবে শিল্পকলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সত্যি বলছি, আমার কর্মকা- নিয়ে সমালোচনা করলে সাদরে গ্রহণ করবো।
শিল্পকলায় ব্যান্ড কিংবা ড্রামস নিষিদ্ধ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন একটি আওয়াজ ওঠে। এটির কারণ কি ছিল?
যেদিন এ কথাটি সোশ্যাল মিডিযায় এসেছে সেদিনই আমার ব্যান্ড শো হয়েছে। শেখ কামাল ‘স্পন্দন’ যেটি প্রতিষ্ঠা করেছে সেই ব্যান্ডটি সেদিন শো করেছে। আমি মনে করি বিদেশি যে কোনো যন্ত্র যদি আমার গানকে সমৃদ্ধ করে তাহলে সেটি ব্যবহারে ক্ষতি তো দেখি না। যে ড্রামসস নিয়ে কথা উঠেছে সেই ড্রামস ব্যবহার কারণে আমাদের দেশে ভূপেন হাজারিকার অনেক গান পাওয়ারফুল হয়েছে।
মূল বিষয়টি হলো কুষ্টিয়াতে শিল্পকলায় একটি ব্যান্ড শো হয়েছে। সেখানে তারা অনেক চেয়ার ভেঙেছে। পরবর্তীতে যারা এসেছে তাদের বলা হয়েছে এ কাজটি যেন না করা হয়। কিন্তু তারা সেটির এনসিউর করতে পারেনি। এটিকে কেন্দ্র করে অনেকে সোস্যাল মিডিয়ায় লিখেছে শিল্পকলায় ব্যান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ আসল সত্যটি জানার চেষ্টা করেনি।