
ছবি: সংগৃহীত
১৯৭২ সালের শেষের দিকে দেশের চারটি ক্যাডেট কলেজ হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ সফর এবং সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের প্রচেষ্টা। ক্যাডেটরা এর তীব্র বিরোধিতা করলে ক্ষুব্ধ হয়ে তোফায়েল আহমেদ প্রতিশোধমূলকভাবে ক্যাডেট কলেজগুলোর বিলুপ্তির সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখেন।
সরকারি ঘোষণায় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ফৌজদারহাট সরকারি আবাসিক কলেজ’। কলেজ চত্বরে নতুন সাইনবোর্ডও টাঙানো হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নেয়নি ক্যাডেটরা। তারা “Keep Cadet Colleges” নামে একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের সূচনা করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা।
এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন প্রাক্তন ক্যাডেট ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা কর্নেল চৌধুরী এম মহসিন। তার পরামর্শেই ক্যাডেটরা ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান ফোনে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর (সে সময় বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের নৌচালনা মন্ত্রী) সাথে ক্যাডেট কলেজের ভাগ্য ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। ব্রিগেডিয়ার জিয়া জেনারেল ওসমানীর সাথে ক্যাডেটদের একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। পরদিনই সকাল ৭:৩০ এ ওসমানীর মিন্টু রোডের বাসায় (বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটনের কমিশনারের কার্যালয়) তার সাথে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক হয়। এই সাক্ষাতেই পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে যায়।
সেদিন ভোরে মিন্টু রোডে ওসমানীর বাসায় সাক্ষাৎ করতে যান কয়েকজন ক্যাডেট। প্রথমে দেখা না হলেও, জোরালো চেষ্টায় ওসমানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তারা। ওসমানী তাদের সঙ্গে সকালের নাশতা ভাগাভাগি করেন এবং আলোচনার পর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তাকে না জানিয়ে ক্যাডেট কলেজ বিলুপ্তির পেছনে কারা ছিল, তা তিনি জানতে চান।
সচিবালয়ে গিয়ে জেনারেল ওসমানী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে রেড ফোনে ফোন করেন। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেন এবং জানিয়ে দেন, “ক্যাডেট কলেজ থাকলে আমি থাকব, না থাকলে পদত্যাগ করবো।” এরপর ওসমানী দ্রুত একটি লিখিত নির্দেশনা তৈরি করে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যান ও প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডিন্যান্স বাতিলের উদ্যোগ নেন।
সেই ঐতিহাসিক দুপুরে সচিবালয়ের ১১ তলায় দাঁড়িয়ে ওসমানী ফাইল হাতে আন্দোলনরত ক্যাডেটদের বলেন, “বয়েস, ক্যাডেট কলেজ থাকছে।” এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনের সফলতা নিশ্চিত হয়।
পরদিনই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের নতুন সাইনবোর্ডে আগের নাম ফিরে আসে—“ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ”। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাসির চৌধুরীও সরকারপ্রদত্ত নামফলক সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
এই ঐতিহাসিক ঘটনায় জেনারেল ওসমানী এবং ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান ছিলেন প্রধান সহায়ক শক্তি। তাঁদের নিষ্ঠা, দূরদৃষ্টি এবং নেতৃত্বে বাংলাদেশের চারটি ক্যাডেট কলেজ রক্ষা পায়। অনেকের মতে, পাকিস্তান আমলে যেমন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ছিলেন ক্যাডেট কলেজের প্রবর্তক, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে জেনারেল ওসমানীই ছিলেন ক্যাডেট কলেজ রক্ষার প্রকৃত জনক।
সূত্র: ক্যাডেট কলেজ ব্লগ