ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১

গণঅভ্যুত্থানে পক্ষে থাকা ঢাকা কলেজ শিক্ষককে বদলি, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

আল জুবায়ের

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গণঅভ্যুত্থানে পক্ষে থাকা ঢাকা কলেজ শিক্ষককে বদলি, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রজনতার পক্ষে থাকা ঢাকা কলেজ আরবী ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ (১৭৯১১) কে ওএসডি  ও ভোলায় বদলি করায় তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সসমালোচনার ঝড়। অতিদ্রুত এই শিক্ষককে বদলির আদেশ প্রত্যাহার না করা হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি  দিয়েছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। 

গত বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহবুব আলম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে সহযোগী অধ্যাপক রহমতুল্লাহ রাজনকে ওএসডি ও সরকারি ফজিলাতুন নেছা মহিলা কলেজ, ভোলায় বদলির আদেশ দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বর্তমান কর্মস্থলে এই শিক্ষক অবমুক্ত হবেন।

জানা যায়, জুলাই ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষা ক্যাডারের সরকারি চাকুরিজীবী হিসেবে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি।

গণঅভ্যুত্থানের সময় ২০২৪ সালের ৩ আগষ্টে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, "সাম্প্রতিক সময়ে সন্তান সমতুল্য যেসব ছাত্র, নিরীহ সাধারণ জনতা নিহত হয়েছে, তাদের হত্যাকারীদের বিচার চাই। গণতান্ত্রিক দেশে কোন অস্বাভাবিক মৃত্যুই কাম্য নয়"। 

সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রহমতুল্লাহর ওএসডি ও বদলির বিষয়ে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী বিশাল সাহা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, রহমতুল্লাহ রাজন স্যার এর আকস্মিক বদলির সংবাদ দেখে আমার মতো ঢাকা কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই মন খারাপ।

তিনি আরও লেখেন, নিয়ম মেনে হোক কিংবা নিয়ম বহির্ভূত ভাবেই হোক, স্যারের এই বদলি মানিনা। ঢাকা কলেজের স্বপদেই বহাল দেখতে চাই স্যারকে। কেউ যদি বলেন, 'বদলির চাকরি, বদলি হবেই, এটাই নিয়ম' তবে বলছি,  যে দেশে অনিয়মেই সব হচ্ছে সেখানে শিক্ষকের জন্য জন্য শিক্ষার্থীদের এই দাবী অস্বাভাবিক কিছু না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কাইয়ুম মজুমদার বলেন, জুলাই-আগস্টের গনঅভ্যুত্থানে ঢাকা কলেজের শিক্ষকরা যখন চাকরি বাঁচাতে ছাত্রদের পক্ষে একটি মুখ খুলেনি। তখন ঢাকা কলেজের ইসলামিক স্টাডিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রহমত উল্লাহ রাজন স্যার ছিলেন তার বিপরীত।

স্যার সব সময় অন্যায়ের বিপক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। তিনি কলেজে ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে কত ধরনের ট্যাগ খেয়েছেন, আমি তার বাস্তব স্বাক্ষী। এতে করে কবিতা আবৃত্তি সংসদ সংগঠনটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

আরও বলেন, স্যারকে আওয়ামীলীগ ট্যাগে ঢাকা কলেজ থেকে ভোলায় পাঠানো হয়েছে। তিনি যদি ভোলায় যান, যারা আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে কাজ করেছিল তাদের কি হবে? এই অন্যায় কখনো মেনে নেওয়া যায় না। এটাই কি জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকার প্রতিদান?

ঢাকা কলেজ আরবি ও  ইসলামী শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদউদ্দিন গালীব বলেন, রহমত উল্লাহ রাজন স্যারকে ডিপার্টমেন্টে আমার থেকে ভালো কেউ জানতো না। একাডেমিক এর বাইরেও স্যারের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে ঢাকা কলেজ এর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র স্যার দাড় করালেন।

তিনি বলেন, আমাদের একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন যিনি দাঁড়িকে ঘাস বলে সম্মোধন করতেন। রাজন স্যারকে শিবির ট্যাগ দিয়ে কলেজ থেকে তাড়ানোর অনেক অপচেষ্টা করেছেন এবং আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের কার্যক্রম একপর্যায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। 

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ এর সেন্ট্রাল কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির হাতে হাত রেখে কিছু শিক্ষককে মহড়া দিতেও দেখেছি। তারা ঠিকই ঢাকা কলেজে রয়ে গেছেন। কিন্তু ছাত্রবান্ধব রাজন স্যারকে কোন আঙ্গিকে ট্রান্সফার আদেশ দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়। অতিদ্রুত স্যারের ট্রান্সফার আদেশ প্রত্যাহার চাই।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি এ জেড আনাস ভূঁইয়া বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকা কলেজের সিংহভাগ শিক্ষক যখন স্বৈরাচারের দোসরদের সহযোগিতা করেছে সেই সময় শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন রহমত উল্লাহ রাজন স্যার। শুধু জুলাই অভ্যুত্থানেই নয় এর আগেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যায় পাশে পেয়েছিল এই শিক্ষাগুরুকে। 

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অতি আপন হওয়ায় শিবির তকমাও পেতে হয়েছিল তাকে। আমি সেই সময় ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি দায়িত্বে। তার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠনটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সংগঠনের দায়িত্বে থাকা রাজন স্যার ও শিক্ষার্থীরা শিবির বলে তকমা দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই ইস্যুতে ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে শিবির তকমা দিয়ে পুলিশের হাতে দেয় তৎকালীন অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীরা। সেই শিক্ষার্থীকে ছাড়ানোর জন্য আমি থানায় গিয়েছিলাম। 

এরপর কলেজের একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিক সমিতি কেন এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে সে বিষয়েও কথা উঠেছিল। এমনকি কলেজের একটি বড় অনুষ্ঠানে তৎকালীন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান বক্তব্যে বলেছিলেন, কোন সংগঠন শিবির কে প্রশ্রয় দিচ্ছে, কারা তাদেরকে ছাড়ানোর জন্য থানায় যাচ্ছে তাদেরকেও মার্ক করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। ওই সময় যারা আওয়ামী লীগের পা চেটেছে সেই শিক্ষকরা সবাই বহাল তবিয়তে। অথচ নিজের চাকরির ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো‌ সেই রহমতুল্লাহ রাজন স্যারকে ঢাকা কলেজ থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও হতাশজনক।

ঢাকা কলেজ আরবী ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, জুলাই আন্দোলনে যখন গোটা ঢাকা কলেজ ফ্যাসিস্ট এর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে, কখনো ছাত্রলীগকে খিচুড়ি খাইয়েছে, চিকিৎসার জন্য অর্থ সহযোগিতা করেছে তখনো আমি সাধারণ ছাত্রদের পাশে ছিলাম। তাদের উদ্বুদ্ধ করেছি বিভিন্ন ভাবে। তারই প্রতিদান হিসেবে এই বদলি। দুঃখ এটাই - যারা ফ্যাসিস্টদের প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিল, ২০/২৫ বছর ধরে ঢাকা কলেজে কর্মরত আছে তাদেরই হীন টার্গেট হয়েছে আমার মত সাধারণ শিক্ষক।

এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, বদলির কারণ আমাদের জানা নেই। এর আগেও বদলি হয়েছিল। মিনিস্ট্রিতে যোগাযোগ করতে হবে। আর সরকারি নিয়ম হলো তিন বছর পর বদলি করা, আমরা বহু বছর আছি অনেকেই। সব সময় নিয়মে হয়না, নিয়মের বাইরেও বদলি হয়।

শরিফুল

×