ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১

তোমাদের জন্য বই

আফরিন সুলতানা তাবাসসুম

প্রকাশিত: ১৯:২৪, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তোমাদের জন্য বই

এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা এলো এমন এক সময় যখন চারদিকে অভ্যুত্থানের আনন্দ। মেলাও সেজেছে বিপ্লবের রঙে। মেলা গেইট থেকে শিশু-কিশোর কর্নার অবধি অভ্যুত্থানের নানা ছবিতে ভরপুর। বইমেলায় অভ্যুত্থানের সাথে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিতে এসেছে সালাহউদ্দিন শুভ্র’র বই ‘গণভবনের ভূত’। বইটি পাইওনিয়ার প্রকাশ করেছে। আসিফ মেহ্দীর  সায়েন্স ফিকশন ‘ব্ল্যাকহোলে হট্টগোল’ প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। শিশুসাহিত্য নিয়ে ব্যাপক কাজ করা রবিউল কমলের ‘রোমেল ও ঘড়িভূত’ এনেছে পাঞ্জেরি। আসার অপেক্ষায় আছে এই লেখকের আরো বেশ কিছু নতুন বই।
কিশোরদের এবারের আগ্রহ দেখা গেছে কমিকস ও মাঙ্গায়। একসময় তুমুল জনপ্রিয় ছিল ‘চাচা চৌধুরী’, ‘নন্টে ফন্টে’, ‘টিনটিন’-এর মতো কমিকস। সময়ের সঙ্গে অ্যানিমেশন প্রযুক্তির উৎকর্ষে কমিকস অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে আশার কথা, নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে কমিকসে। শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি তরুণরাও দেশ-বিদেশের কমিকস পড়ছে। বিশেষ করে জেন-জি প্রজন্মের কাছে জাপানি কমিকস মাঙ্গা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই বইমেলায়ও অনেক পাঠক খুঁজছে পছন্দের কমিকস ও মাঙ্গার অনুবাদ।

কিশোরদের জন্য

কিশোর-কিশোরী ও তরুণরা এবার বেশি খুঁজছে অন্তিক মাহমুদ, মেহেদী হক ও আহসান হাবীবের কমিকস। বিশেষ করে ঢাকা কমিকস বেশ কয়েক বছর বড়দের কমিকস, মাঙ্গা এসব নিয়ে কাজ করছে। প্রকাশনীটির ‘দুর্জয় সিরিজ’, ‘মফিজউদ্দিন’, ‘ইব্রাহিম’Ñ এ সমস্ত সিরিজের প্রতি কিশোরদের দারুণ আগ্রহ দেখা গেছে।
থ্রিলারের জগতের মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীনের ‘ঢাবাকা’ নিয়ে এর আগেই কমিকস হয়েছে। বাতিঘর প্রকাশনী থেকে ঢাউস সাইজের এ বই লাইন ধরে কিনতে দেখা গেছে থ্রিলার ও কমিকস ভক্তদের। এছাড়া নানা সায়েন্স ফিকশনের পাশাপাশি টাইম ট্রাভেল সম্ভব কি না, কিভাবে মেশিন বানানো যায় এসব নিয়ে পল ডেভিসের বই ‘হাউ টু বিল্ড আ টাইম মেশিন’ এর অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার। প্রথমা থেকে এটি প্রকাশ হয়েছে।
বইমেলায় শুক্রবার ছাড়া তেমন উপচেপড়া ভিড় এবার চোখে পড়েনি। তবে বিকেলের পর থেকেই জমজমাট পরিবেশ আঁচ করা যায়। থ্রিলার লেখক অন্তিক মাহমুদের নতুন ক্রাইম থ্রিলার কমিকস ‘ভুল’ এসেছে। অন্তিক মাহমুদ বলেন, ‘আমি চাই বাংলাদেশে কমিকস বইয়ের বড় জায়গা তৈরি হোক। কারণ, গল্প পড়ার সময় মস্তিষ্কে একটি কল্পচিত্র তৈরি হয়, আর কমিকস সেটিকে আরও সহজ করে দেয়।’
ঢাকা কমিকস, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন, উন্মাদ ও সোর্স স্টলে ছিল কমিকস ও মাঙ্গার প্রচুর চাহিদা। সোর্সের  নাসির হোসেন নয়ন জানান, ‘গত তিন বছর ধরে আমরা মাঙ্গা প্রকাশ করছি। শুক্র ও শনিবার আমাদের স্টলে উপচে পড়া ভিড় থাকায় বোঝা যায়, দেশে মাঙ্গার চাহিদা কতটা বেশি।’ জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব বলেন, ‘একসময় বইমেলায় কমিকসকে বই বলেই স্বীকার করা হতো না। এখন প্রকাশকরা বুঝতে পেরেছে, কমিকসও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিশ্বজুড়ে গ্রাফিক নভেলের বিপ্লব চলছে। তরুণরা সাধারণ বই কম পড়লেও গ্রাফিক নভেল পড়তে আগ্রহী, কারণ এখানে ছবি থাকে।’

শিশুদের জন্য নতুন বই

এবারের বইমেলায় শিশুদের জন্য বেশ কিছু নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে, মানিক চক্রবর্তীর ‘মেঘপরির দেশে’। জুন্নুন মিশরীর ‘ঢোকশা’, সালমান ফারসির ‘ভূতের বাড়ি’, মাসউদ আহমাদের ‘রুশার খাতায় ফুলের গন্ধ’, ও ‘পিংকি ও জীবনানন্দ কাকু’।

শিশু চত্বর ও মেলার পরিবেশ

এবারের শিশু চত্বর সাজানো হয়েছে রঙিন ও আকর্ষণীয়ভাবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে গাছ, ফুল, জেব্রা, জিরাফ ও পাখির ছবি দিয়ে সাজানো নান্দনিক ফটক। শিশু চত্বরে অংশ নিয়েছেÑ ‘শব্দশিল্প’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘শিশুরাজ্য’, ‘ফুলঝুড়ি’, ‘পঙ্খীরাজ’, ‘শিশুবেলা’, ‘চিরন্তন প্রকাশ’, ‘শৈশব প্রকাশ’, ‘ছোটদের সময়’ ও ‘কাকাতুয়া’সহ জনপ্রিয় অনেক প্রকাশনী। বাংলা একাডেমির শিশুতোষ বইয়ের স্টল থাকলেও এবার নতুন কোনো বই প্রকাশ করেনি। তবে ছুটির দিনে শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। শিশু চত্বরে শুধু বই কেনাবেচা নয়, ছিল বিভিন্ন মজার আয়োজনÑ লেখক ও প্রকাশকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ, বই পড়ার আসর, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং পাপেট শো।

কমিকস ও মাঙ্গায় দৃষ্টি

একটা সময় ছিল হুমায়ূন আহমেদের রাজত্ব। তার বই দিয়ে কিশোররা ঢুকতো পাঠের জগতে। এখন আবার কমিকস-মাঙ্গা ফিরে এসেছে। এক মা তার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলায় ম্যাগাজিন লুকিয়ে পড়তাম। এখন আমার মেয়ে বাধাহীনভাবে কমিকস পড়তে পারছে। এটা একটা মানসিক প্রশান্তির জায়গা।’
এবারের বইমেলায় কিশোরদের জন্য নতুন বইয়ের সংখ্যা বেশ কম। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়াকে দায়ী করছেন প্রকাশকরা। তবে এরমধ্যেই গার্ডিয়ান প্রকাশনী এনেছে ৪ খণ্ডে গল্পে গল্পে বিজ্ঞান সিরিজ। সিরিজটি লিখেছেন ড. উম্মে বুশরা সুমনা। লেখক বলেন, ‘এই সিরিজ কিশোরদের চিন্তা ও কল্পনাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে রহস্য এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কিশোরদের জন্য এই বই দারুণ হবে বলে আমার বিশ্বাস।’ এই সিরিজে আছে ‘দুই মেরুর হয় নাকো দেখা’, ‘বাঁশ বাগানের ভু...ত’, ‘আলোর ম্যাজিক’ ও ‘চলো সমুদ্রে যাই’।
কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের কাছে একাধিক প্রকাশনা যেমন নতুন বই তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তেমনি চোখে পড়েছে অন্যদের অবহেলাও। তবুও পঁচিশের বইমেলা তরুণদের, কিশোরদের। বইমেলার আগে জুলাইতে গুলিতে শহীদ হয়েছেন বহু শিশু-কিশোর-তরুণ। হয়তো তারাও মেলায় আসতেন, যোগ দিতেন মেলার কোলাহলে। তাদেরও পদচিহ্ন পড়তো মেলার মাঠে, ধুলায়। এবারের বইমেলা সেইসব চিরসবুজ শিশু-কিশোরদের মিস করছে নিঃসন্দেহে।

×