ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আন্দোলন নতুন কিছু নয়। তবে, যখন একটি আন্দোলন শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির চেয়ে বিশৃঙ্খলা, অপপ্রচার ও স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক কৌশলের রূপ নেয়, তখন তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। সম্প্রতি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন এমনই এক হাস্যকর ও অনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা দেশের সাধারণ জনগণের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
প্রথমে পাথর, তারপর অনশন—শেষমেশ নির্লজ্জতা
প্রথমদিকে এই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে হলেও দ্রুতই এটি বিশৃঙ্খল এবং অনৈতিকভাবে পরিচালিত হতে শুরু করে। ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের মতো প্রাণঘাতী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের বিরক্তি ও ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে আন্দোলনকারীরা। এরপর সচিবালয়ে গিয়ে অনশন কর্মসূচি গ্রহণ করলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা লজ্জিত হয়নি, বরং আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে কলেজের নামফলক খুলে নিজেদের ইচ্ছেমতো ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি বসিয়ে দিল।
শুধু তা-ই নয়, সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি, মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানো, ধর্মীয় সংখ্যালঘুতা নিয়ে কৌশলী অপপ্রচার চালানোসহ নানা বিতর্কিত কার্যক্রম চালিয়ে তারা নিজেদের আন্দোলনকে পুরোপুরি হাস্যকর ও অনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার অভাব, সেখানেই নাটকীয় আন্দোলন
এই আন্দোলনের অন্যতম মর্মান্তিক দিক হলো, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেতে চায়, তারা নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা দিয়ে তা অর্জনের চেষ্টা করেনি। গণমাধ্যমে যখন তারা নিজেদের দাবি তুলে ধরছিল, তখন তাদের উচ্চারণ, বাক্যগঠন, এমনকি সাধারণ বাংলা পড়ার অক্ষমতা দেখে মানুষ আরও বেশি বিরক্ত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে হলে একাডেমিক যোগ্যতা, গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। অথচ এই আন্দোলনকারীরা সেসব চেষ্টার চেয়ে রাস্তা বন্ধ করে, ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে, আর পাঁচবেলা খেয়ে ‘অনশন’ করে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে।
সর্বোচ্চ নির্লজ্জতার মাপকাঠি
শুধু আন্দোলন নয়, তাদের অনশনও ছিল কৌতুকের বিষয়। দিনে পাঁচবেলা খাবার খেয়ে আধবেলা অনশন করে এমন ‘প্রতিবাদ’ বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল। সামাজিক মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যেভাবে বিদ্রুপ হয়েছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।
এই আন্দোলনের সর্বশেষ কর্মসূচি ছিল মহাখালী অবরোধ, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’। আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী পঁয়ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী বারাসাত থেকে মহাখালী পর্যন্ত অবরোধ করবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, অবরোধ শুধু মহাখালীতে, বারাসাতে কিছুই ঘটেনি। অবশেষে রেললাইন অবরোধের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়, যেখানে গণধোলাইয়ের হাত থেকে কোনোমতে বেঁচেছে তারা।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আন্দোলন ও ভারতীয় প্রভাবের গন্ধ
এই আন্দোলনের পেছনে ভারতীয় স্বার্থ জড়িত থাকার গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে দমন করতে চায়। এই আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপে ভারতীয় আগ্রহী মহলের ইন্ধন থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
যে আমলারা এই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি, তারাই অবশেষে জানিয়ে দিলেন যে, নির্বাচিত সরকার না থাকলে এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা সম্ভব নয়। ফলে আন্দোলনকারীরা বাধ্য হয়ে তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়।
ব্যক্তিত্বহীন কিছু শিক্ষার্থীর কারণে প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম
এই কলেজ থেকে বহু শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু এখন থেকে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান পরিচয় দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়বে, কারণ কিছু নির্লজ্জ শিক্ষার্থীর জন্য কলেজটি সারাদেশের বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন হাস্যকর আন্দোলন এর আগে খুব কমই দেখা গেছে। এর চেয়েও বেশি সমস্যাজনক হলো, কিছু নির্লজ্জ ও অযোগ্য ব্যক্তির কারণে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হওয়া। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন দরকার, তবে তা হয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা, গবেষণা ও একাডেমিক উৎকর্ষের মাধ্যমে— ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে নয়, রাস্তা অবরোধ করে নয়, ধর্মকে অপব্যবহার করে তো নয়ই।
এই আন্দোলনের ব্যর্থতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সম্মান অর্জনের একমাত্র পথ হলো কঠোর পরিশ্রম ও যোগ্যতা। বিদ্রুপের পাত্র হয়ে নয়, মেধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা অর্জন করাই প্রকৃত সংগ্রাম হওয়া উচিত।
শিহাব