ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১

গণবিশ্ববিদ্যালয়

স্বাদে ও সংস্কৃতিতে মিলনমেলা

সানজিদা জান্নাত পিংকি

প্রকাশিত: ১৮:৪৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

স্বাদে ও সংস্কৃতিতে মিলনমেলা

হিমজড়ানো জানুয়ারির সকাল। সাভারের আকাশ তখনো কুয়াশার ভারে নুয়ে আছে। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে বাঙালির শীতকালীন ঐতিহ্যের এক সখ্যের মুহূর্ত। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) প্রাঙ্গণ রূপ নিয়েছে এক অনন্য মেলবন্ধনেÑ যেখানে পিঠার সৌরভ, সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য আর হৃদয়ের উষ্ণতায় বোনা হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের মায়াবী চাদর।

প্রথমে চোখে পড়ে মাঠজুড়ে গড়ে ওঠা স্টলগুলোর শিল্পময় সাজ। বাঁশ, খড়, কলাপাতা আর কাগজের রঙিন দোলায় সজ্জিত প্রতিটি স্টল যেন গ্রামীণ বাংলার এক টুকরো আঙিনা। কিন্তু এই সাজ শুধু বাহ্যিক নয়; প্রতিটি স্টলের নাম আর তাদের পিঠার উপস্থাপনা যেন একেকটি কাব্য। ‘মাইক্রোবিয়াল মিষ্টান্ন’, ‘সামাজিক পিঠা ঘর’, ‘কানুনি পিঠা মহল’, ‘পিঠা রঙ্গন’, ‘ঢেঁকি বৈঠক’, ‘পিঠাকুঞ্জ’, ‘অ আ ক খ পিঠা ঘর’, ‘রসায়নের রসনা’, ‘বিন্নি ধানের খৈ’Ñ এই নামগুলো কেবল শিরোনাম নয়, বরং এরা বাঙালির শেকড়ের প্রতিধ্বনি।
পিঠার যে আয়োজন এখানে চোখে পড়ে, তা যেন শুধুই স্বাদের নয়Ñ এটি আমাদের সত্তারও বহির্প্রকাশ। ভাঁপা পিঠার ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকে শীতের সকালে উঠোনের স্মৃতি, পাটিসাপটার প্রতিটি ভাঁজে যেন মায়ের যত্নের ছাপ। গোলাপ পিঠা, জামাই পিঠা, নকশি পিঠা, বোমা পিঠা, লবঙ্গ লতিকাÑ এসব পিঠার রূপ আর স্বাদে যেন বাঙালির সংস্কৃতি তার সম্পূর্ণ রূপে হাজির হয়। শুধু কি তাই? নারকেল পুলি কিংবা ইলিশ পিঠার মতো অভিনব ধারণাগুলোর মাধ্যমে উঠে আসে আমাদের সৃজনশীলতার বহুমাত্রিকতা।
তবে পিঠাউৎসব কেবল খাবারের আয়োজনেই থেমে থাকেনি। সকালবেলা থেকেই শুরু হয় এক প্রাণচাঞ্চল্যকর পরিবেশ। মাঠজুড়ে শিক্ষার্থীদের হাঁকডাক, মুখে হাসি, আর স্টল সাজানোর উন্মাদনায় ক্যাম্পাস যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। মঞ্চে চলতে থাকে লোকসংগীতের সুর। এসব গানের প্রতিটি শব্দ যেন পিঠার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এই উৎসবে কেবল শিক্ষার্থীরাই নন, অংশ নেন অতিথি, শিক্ষক আর আশপাশের গ্রামীণ জনপদের মানুষ। স্টলগুলো ঘুরে দেখা, পিঠার স্বাদ নেওয়া, আর এর সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠা যেন এক সেতু তৈরি করে। এখানে আর বয়স বা পদমর্যাদার ভেদ থাকে না; সবাই যেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক স্রোতে ভেসে যায়।
উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ছিল পিঠার বিতর্ক। এ যেন বাঙালির চিরকালের মুক্তচেতনার প্রতীক। অন্যদিকে মঞ্চের আবৃত্তি, লোকনৃত্য আর নাটকে উঠে আসে আমাদের সংস্কৃতির অমোচনীয় গল্প। প্রতিটি মুহূর্ত যেন স্মৃতি হয়ে মনের গভীরে বসে থাকে। উৎসবের আয়োজনে অতিথিদের প্রশংসা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা বললেন, ‘এই আয়োজন কেবল বিনোদন নয়; এটি আমাদের শেকড়ের প্রতি, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি, আর আমাদের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা। এই প্রজন্মকে শিকড়ের সুধায় ভিজিয়ে দিতে এমন আয়োজনের বিকল্প নেই।’ পিঠার উৎসব শেষে যখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে, ক্যাম্পাস তখনো জ্বলজ্বল করে সেই আনন্দের রেশে। মাটির সুর আর পিঠার মিষ্টতায় যে ভালোবাসার গল্প রচিত হলো, তা হয়তো কোনো এক শীতের সকালে ফিরে আসবে আরেকটি নতুন প্রজন্মের হাতে।
গণবিশ্ববিদ্যালয়ের এই পিঠা উৎসব তাই কেবল একদিনের উৎসব নয়; এটি বাঙালির চিরন্তন সত্তার প্রতি এক ভালোবাসার নিবেদন। পিঠার প্রতিটি টুকরো যেন আমাদের শেকড়ের শক্তি আর ঐতিহ্যের সৌন্দর্যের এক নিপুণ প্রতীক। এমন আয়োজন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পিঠার ভাঁজে মিশে থাকা গল্পগুলো কখনোই হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।

×