চাকরি শেষে পেনশনের অপেক্ষায় রয়েছেন ৪০ হাজার শিক্ষক
চাকরি শেষে পেনশনের অপেক্ষায় রয়েছেন ৪০ হাজার শিক্ষক। নিজেদের জমানো টাকা পেতে বছরের পর বছর ঘুরছেন তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই অফিস থেকেই দুই সচিব পদত্যাগ করেছেন। নতুন করে প্রতিষ্ঠানটিতে সচিব নিয়োগ দেয়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বোর্ড পরিচালনার জন্য করা হয়নি পরিচালনা পর্ষদ। বরং যেসব কর্মকর্তা বছরের পর বছর রাজনৈতিকভাবে পদ আকড়ে ছিলেন, তারাই এখন ভোল পাল্টে প্রতিষ্ঠানটিতে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার থেকে চার হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেলে শিক্ষকদের কোনো ভোগান্তি থাকবে না। কিন্তু বছরের পর বছর এই দাবি করা হলেও কোনো সরকারই শিক্ষকদের প্রতি সদয় হয়নি। আর এই ভোগান্তির কারণে প্রতিষ্ঠান দুটিও অনিয়ম-ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।
রাজধানীর নীলক্ষেতে ব্যানবেইস অফিসের নিচে অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের অফিস। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা চাকরি জীবন শেষে এখান থেকেই দুই ধাপে অবসরকালীন অর্থ পান। এই অর্থ পেতে ঘুষ, দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারা। এই দুই প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সংস্থান না থাকায় তিন-চার বছর ঘুরেও তারা টাকা পাচ্ছেন না। চাকরি শেষে শিক্ষকরা চরম মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপে জীবন পার করছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে অফিসটিতে ৭০-৮০ বছর বয়সী একাধিক ব্যক্তি কাগজ হাতে কর্মকর্তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় গেলেও তারা কর্মকর্তার দেখা পাচ্ছেন না। এসব প্রবীণ শিক্ষক বলেন, সারাজীবন শিক্ষকতা করা মানুষ পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকে। কিন্তু চাকরি জীবন শেষে তারাই পরিবারের বোঝা হয়ে উঠেছেন।
যারা আজীবন সমাজ আলোকিত করেছেন। সেই মানুষটিই আজ সমাজে মুখ দেখাতে পারছেন না। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে রোগ-শোক আর অর্থগ্লানি নিয়ে সময় পার করছেন। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ৩০-৪০ বছর চাকরি করেও পেনশন পাচ্ছেন না। তিন-চার বছর আগে চাকরি শেষ করেও তারা নীলক্ষেতের অফিসে দিনের পর দিন ঘুরছেন। অনেক শিক্ষক অবসরকালীন অর্থ জীবদ্দশায় না পেয়ে পরপারে গেছেন। এরপর তার সন্তানও বছরের পর বছর ঘুরে চলেছেন।
অভিযোগ রয়েছে প্রতি আবেদনে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য চলে অফিসটিতে। এই দপ্তরে বর্তমান সময়ে উপ-পরিচালক রয়েছেন দুইজন। এই দুই উপ-পরিচালক অন্তত ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত রয়েছেন। অর্থাৎ তারা শিক্ষা ক্যাডার ও নিয়ম অনুযায়ী তাদের তিন বছর পর পর বদলি হওয়ার কথা। সম্প্রতি উপ-পরিচালক তপতী হালদার পদোন্নতি পেয়েও এই প্রতিষ্ঠানটিতে বহাল রয়েছেন।
আরেকজন আছেন নাহিদা চৌধুরী। তবে শিক্ষা ক্যাডারের মো. ইলিয়াস হোসাইন আগে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বিবেচনায় দপ্তরটিতে পদায়ন পেলেও এখন তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করছেন। অথচ সততার রানী ডা. দীপু মনিসহ তার অনেক লেখা ও কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যার প্রমাণও জনকণ্ঠের হাতে রয়েছে।
অফিস সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ সময় কল্যাণ ট্রাস্ট্রের সচিব পদে ছিলেন শাহজাহান সাজু। ৫ আগস্টের পর তিনি আর অফিস করেননি। প্রায় মাস খানেক পর তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। এরপর ট্রাস্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন পরিচালক আবুল বাশার। তিনি রুটিন দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনিও সম্প্রতি অবসরে গেছেন। এখন এই পদে কেউ নেই। একই অবস্থা অবসর বোর্ডের। ৫ আগস্টের পর আর অফিসে আসেননি শিক্ষক নেতা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ মোহাম্মদ সাদী। তিনি কোথায় আছেন কেউ জানে না।
এরপর ব্যানবেইসের কর্মকর্তা আবু জাফর আহমেদকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনিই অফিস সামলাচ্ছেন। তবে বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। অফিস সূত্র বলছে তার সন্তান বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এজন্য তিনি অফিসের বাইরে আছেন।
এ বিষয়ে অবসর বোর্ডের কর্মকর্তা জামাল হোসাইন জনকণ্ঠকে জানান, অবসর পরিচালনা পরিষদ নেই। আগে যারা আছে তাদের কোনো এক্টিভিটিস নেই। নতুন পর্ষদ এখনো দেয়নি। নতুন শিক্ষকদের আবেদনের বিষয়ে কাজ করতে পর্ষদের অনুমোদন লাগবে। ৫ আগস্ট এর আগে যে অনুমোদন ছিল সেগুলোর টাকা পর্যায়ক্রমে ছাড় পাওয়া সত্ত্বে শিক্ষকদের দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া ছিল। সেসব শিক্ষকরাই টাকা পাচ্ছেন।
প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষকের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসে আবেদন ও টাকার পরিমাণ বাড়ছে। মাসে গড়ে এই বোর্ডে ৯০০টির বেশি আবেদন জমা পড়ে। অবসরের এই আবেদন নিষ্পত্তি করতে মাসে প্রয়োজন ১০৬ কোটি টাকা। শিক্ষকদের এমপিও কর্তন থেকে জমা পড়ে ৭০ কোটি টাকা। আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে দেওয়া সিড মানি ও ব্যাংকে রাখা এফডিআরের লভ্যাংশ আসে ৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি মাসে ৩৩ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি থাকে।
একইভাবে বছর হিসেবে দেখা যায়, প্রতি বছর আবেদন সংখ্যা ১০ হাজার ৮০০টি। এই আবেদন যারা করেছেন তাদের অর্থ পরিশোধ করতে প্রয়োজন ১২শ’ ৭২ কোটি টাকা। এমপিওর ৬ ভাগ টাকা থেকে আয় হয় ৮৪০ কোটি টাকা। বছরে এফডিআর থেকে লভ্যাংশ আসে ৩৬ কোটি টাকা। এরপরও প্রতি বছর ঘটতি থাকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক সরকারের দেওয়া ৫০০ কোটি টাকা ছাড়াও অল্প কিছু টাকা ছিল বোর্ডের। সেই অর্থ ও সিড মানির পরিমাণ বেড়ে এখন ৬৭০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর ব্যাংক থেকে সাড়ে সাত শতাংশ ইন্টারেস্ট পায় বোর্ড। এই আয় থেকে আগে ১০ শতাংশ উৎস কর এনবিআরকে দিতে হতো। কিন্তু এখন তা আরও ২০ শতাংশ বাড়িয়ে চাইছে এনবিআর। এতে প্রতি বছর ১৩ কোটি টাকার বেশি উৎস কর তাদেরকে দিতে হবে।
এই অফিস সূত্র জানায়, অবসরকালীন দুই অফিস ৩-৪ বছর পিছিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ তিন-চার বছর আগের আবেদনের অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে দীর্ঘদিন এগুলো নিয়ে ব্যত্যয় ছিল। কারণ বিশেষ সুপারিশ ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণে অনেকে আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই অর্থ পেত। এর ফলে পেছনে থাকা আবেদনকারীরা আরও পিছিয়ে যেত।
এসব বিষয়ে শিক্ষকরা জানান, টাকা পাব পাব করেও অবসরের এই টাকা পায় না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। যে কারণে এলাকার মুদি দোকান থেকে বাকি খেতে হচ্ছে। বাকি না মিটিয়ে উল্টো ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। অনেকে আবার সন্তানকে অর্থাভাবে বিয়েও দিতে পারছেন না।
অবসর বোর্ড সূত্র বলছে, এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে ৪ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। সর্বশেষ ১ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল বিগত সরকারের। কিন্তু সরকার পতনের পর তা বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকদের প্রতি মাসে জমা যে ৬ পারসেন্ট টাকা পাওয়া যায় সেই টাকা দিয়ে অবসর বোর্ড চলছে।
এই দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দুই ধাপে এই আবেদন নিষ্পত্তি সম্ভব। সরকার আমাদের চার হাজার টাকা ভর্তুকি দিলেই সব শিক্ষক পেনশনের অর্থ পাবেন। এ ছাড়াও প্রতি বাজেটে এই খাতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া গেলে প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবে চলবে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে শিক্ষা উপদেষ্টা এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বলেছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জমানো ৬ হাজার কোটি টাকা যে ব্যাংকে রাখা হয়েছিল সেটি দেউলিয়া হওয়ায় তাদের সঞ্চয়ের কোনো টাকাই এখন আর নেই। তিনি জানান, এই অর্থ হলে আমরা শিক্ষকদের পেনশনসহ সব দায়দেনা মেটাতে পারতাম।