ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

আসন্ন ভর্তি পরীক্ষা বড় সমস্যা ॥ আন্দোলন প্রত্যাহার

সাত কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করতে ৫ বাধা

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫

সাত কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করতে ৫ বাধা

ঢাকা কলেজে মঙ্গলবার ৭ কলেজ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়

রাজধানীর সাত কলেজের সবগুলোতেই রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) শিক্ষার্থী। কলেজগুলোর শিক্ষকদের প্রায় সবাই বিসিএস ক্যাডার। বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের মানসিকতার পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া আইনি জটিলতা স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয় গঠনে বড় সমস্যা। অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতা ও সমন্বয়হীনতা আছেই। সব মিলিয়ে সাত কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তরে অন্তত পাঁচ বাধা দেখছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

যদিও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে অধিভুক্তি বাতিলে এরই মধ্যে স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবির উপাচার্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। সরকারকে না জানিয়েই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এই অধিভুক্তি বাতিল করেছে বলে অভিযোগ তোলেন।
সাত কলেজকে বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তরে এখন সবচেয়ে বড় বাধা ¯œাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি। ঢাবির অধীনে না থাকায় কোন পদ্ধতিতে এই কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার ঊর্ধ্বতনরা। কারণ এসব কলেজ জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনেও আর যেতে চায় না।

এই সংকট নিরসনে আশু কোনো সমাধানের পথও দেখছেন না তারা। এ ছাড়া অন্যতম একটি বাধা এইচএসসির শিক্ষার্থীরা। কারণ কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে তো এইচএসসির শিক্ষার্থীরা থাকে না। এসব কারণে সাত কলেজের এই স্তরের শিক্ষার কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
সাত কলেজের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে মান-মর্যাদা ও পড়াশোনার ধরন তার সঙ্গে এসব কলেজের শিক্ষকদের পার্থক্য স্পষ্ট। কলেজগুলোকে বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে এসব শিক্ষক বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াবে, না নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে সেটিরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। শিক্ষার্থীরা জানান, সাত কলেজের সঙ্গে সর্বোচ্চ বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে ঢাবি। একাধিক শিক্ষার্থীকে থার্ড ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস দেওয়ায় অনেকেই ভালো চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতেও পারে না।
এ ছাড়া প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয় অনুমোদনে স্বতন্ত্র আইন প্রয়োজন হয়, যা সংসদে অনুমোদন হতে লাগে। তবে এই কলেজগুলোর বিশ^বিদ্যালয়ে পরিণতি পেতে সরকার কোন পথে এগোবে সেটিও স্পষ্ট নয়। নতুন শিক্ষাবর্ষে ঢাবির অধীনে শিক্ষার্থীরা না এলেও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ঢাবির অধীনে থাকছে। স্বতন্ত্র একটি বিশ^বিদ্যালয় হলে তারাও ঢাবি থেকে বের হয়ে আসার আন্দোলন করতে পারে সে শঙ্কাও আছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষজ্ঞ কমিটিতে থাকা অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, অধিভুক্তি বাতিলে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। তার মধ্যেই তো এত বড় ঘটনা হয়ে গেল। এখন ঢাবি অধিভুক্তি বাতিলের বিষয়টি জানিয়েছে।

উপাচার্য যেটি বলেছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি ভর্তির বিষয়টি সুরাহা করবে। আমার এখনো বিষয়টি নিয়ে কোনো ধারণা নেই। সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে হয়তো একটা প্রক্রিয়া বের করা হবে। সেটা কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত যত শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন, তাদের সার্বিক দিক দেখভাল করবে ঢাবি। তবে সেক্ষেত্রেও ঝামেলা এড়াতে মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় ঢাবি। সরকারি সাত কলেজ হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি বাঙলা কলেজ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মহসীন কবীর সংকটের বিষয়ে জনকণ্ঠকে জানান, সাত কলেজের মধ্যে আগে থেকেই মারাত্মক সমন্বয়হীনতা রয়েছে। যে কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে।
তিনি মনে করেন, একটি স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এর অধীনে সাত কলেজকে আনা যেতে পারে। ভবিষ্যতেও বিশ^বিদ্যালয়টিতে এমন কার্যক্রম রাখা হবে, যাতে অন্য কলেজ ভালো করলে তারাও এর অধীনে আসতে পারে। কিন্তু সাত কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয় বিনির্মাণে অবকাঠামো ও কারিকুলাম পরিমার্জন বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে।
হঠাৎ অধিভুক্তি বাতিলে সংকট বাড়বে বলে মনে করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএম ফায়েজ। তিনি বলেন, বড় একটা সংকট যে তৈরি হলো, তাতে সন্দেহ নেই। ভালো হতো যদি স্বাভাবিকভাবে সাত কলেজকে স্বতন্ত্র কাঠামোতে নেওয়ার যে চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটা নিয়মমাফিক হতো। আগামী বছর থেকে সেটা করার চেষ্টা করছিল সরকার। হঠাৎ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অধিভুক্তি বাতিলের ঘটনায় সাত কলেজের ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়বে।
তিনি বলেন, আমি আশা করছি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবে। শিক্ষার্থীরা কী চায়, তাদের আকাক্সক্ষা কী, তাদের আগ্রহটা কোথায়, সেটা বুঝে যৌক্তিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। এক্ষেত্রে ইউজিসি সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। সেই হিসেবে প্রায় আট বছর ঢাবির অধীনে ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম চলে সাত কলেজে। সোমবার আট বছর পর অধিভুক্তি বাতিল করে ঢাবি। সংঘাতের পর সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে সেই সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমরা আলোচনার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল আগামী বছর অর্থাৎ, ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি কার্যক্রম ঢাবি পরিচালনা করবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত এক বছর এগিয়ে এনেছি। চলতি (২০২৪-২৫) শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি ঢাবির অধীনে নেওয়া হবে না।’
তবে সরকারকে কোনো কিছু না জানিয়ে ঢাবি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করেছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। মঙ্গলবার দুপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ঢাবি যে ঘোষণা দিয়েছে, এটা আমার সঙ্গে আলোচনা করে তো দেয়নি। তাদের (সাত কলেজে) এ বছর থেকেই ভর্তি করা হবে না, এটার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
ঢাবির অধীন মুক্ত হওয়া প্রশ্নে সাত কলেজ নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা সমাধানের পথ ভেবে পাচ্ছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাবির অধীনে সাত সরকারি কলেজের ভর্তি এ বছরই বন্ধের সিদ্ধান্তে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে সাত কলেজ নিয়ে নতুন একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রত্যাহার ॥ ঢাবির উপ-উপাচার্যের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম ঘোষণার একদিন পর সরকারের আশ্বাসে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠকের পর নিজেদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান শিক্ষার্থীরা।
বৈঠকের পর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের ছয় দফা দাবির প্রথম দিকের একটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, সেজন্য সন্তোষ প্রকাশ করেছিলাম। বাকি পাঁচ দাবির জন্য গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। এছাড়া ঢাবি কর্তৃপক্ষ উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবির বিষয়টি বিবেচনা করবে।
এই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা আমাদের আলটিমেটাম প্রত্যাহার করছি। কারণ, আমাদের ছয় দফা দাবির বেশির ভাগই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা শুনেছেন। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবিগুলো বিবেচনার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে, তাই আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করলাম।
রূপরেখা চেয়ে আল্টিমেটাম ॥ রাজধানীর সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপরেখা চেয়ে ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র আবদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সাত কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে তার একটি বিস্তারিত রূপরেখা চাই।’
ঢাকা কলেজ মিলনায়তনে সাত কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার পর তিনি বলেন, রূপরেখা তৈরির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি আমাদের জানিয়েছে যে তাদের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং শীঘ্রই এটি জমা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে, আমরা এর জন্য ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি।

×