উচ্চশিক্ষার আমূল সংস্কারসহ অবলিম্বে শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে চিন্তা ও জ্ঞান সংস্কারে নিবেদিত থিংক ট্যাঙ্ক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি)।
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা) এর কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং শিক্ষা উদ্যোক্তা ড. এম আবদুল আজিজ। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় উচ্চশিক্ষার মান ধরে রাখার জন্য সংখ্যা না বাড়িয়ে গুণগত মানের দিকে নজর দেয়া উচিত। এ লক্ষ্যে ঢাকা ও জেলার পরিবর্তে বিভাগীয় শহরে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন/আনুমোদন দেয়া যেতে পারে। দেশের শ্রম বাজার এবং বিশ্বশ্রমবাজারে জনশক্তি রপ্তানির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ডিপ্লোমা চালু করা উচিত, যাতে করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়। এ ছাড়া কারিগরি ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করার জন্য কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সম্প্রসারণ, গবেষণা কার্যক্রম এবং শিক্ষা মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে জেলা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কারিগরি শিক্ষার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা উচিত।
তিনি আরো দাবি করে বলেন, দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে Fully Research Based University তে রুপান্তরিত করা। এ ছাড়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ৬০% Teaching Based & ৪০% Research Based -এ উন্নীত করা। কৃষিনির্ভর দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি উন্নত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। ১ম- ৪র্থ আন্তর্জাতিক মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত (১৯৭৭-১৯৮৩) মক্কা ডিক্লেয়ারেশনে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গৃহিত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে যা- পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই, পরবর্তী শিক্ষা সংস্কার কমিশন অবশ্যই সেই ডিক্লেয়ারেশনে গৃহীত সুপারিশমালার বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি বিষয়ের সাথে ‘প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় কোর্স’ বাধ্যতামূলক করতে হবে। যেমন, অর্থনীতিতে ইসলামী অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তা, আইনে ইসলামিক লিগ্যাল থিওরি ইত্যাদি। আমাদের দেশের শিল্প এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর সাথে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগ চালু ও শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা, যাতে করে আমাদের দেশকে ভিন্ন দেশ থেকে লোক নিয়োগ করতে না হয় (টিআইবি’র তথ্যমতে বাংলাদেশে ৫ লাখ ভারতীয় কর্মরত আছে)। যে বিষয়ে আমাদের দক্ষ জনশক্তি দরকার, সেই পরিমাণ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় Corporate interest-এ সংযুক্ত অপ্রয়োজনীয় পাঠ্যবিষয়গুলো বাদ দিয়ে social interest-এ প্রয়োজনীয় নতুন বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একই সাথে, শ্রমবাজারের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ নেই, সেগুলোকে ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সাথে একীভূত করে বিলুপ্ত করতে হবে।
শিক্ষকদের জন্য ‘ Pedagogy Skills (Art of Teaching)-এর পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষণ প্রশিক্ষণ (Subject based Teaching Method) বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য জাতীয়ভাবে পৃথক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করতে হবে- যেখানে শিক্ষকদের pre-service ও in-service প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া ঐ ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষকদের বাধ্যতামূলক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদেশি ডিগ্রীধারী হতে হবে। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া মেধাবীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এ লক্ষ্যে জেএসসি, পিএসসির আদলে ‘এডুকেশন সার্ভিস কমিশন’(ইএমসি) গঠন করতে হবে- যা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের তুলনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈষম্যবিহীন হবে।
সব লেভেলের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, ব্যবহারিক দক্ষতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে (বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ৫০%, বিশেষায়িত জ্ঞান ২০%, জীবনমুখী দক্ষতা ১০%, নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ ১০%, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ ১০%)। সব লেভেলের শিক্ষক মূল্যায়নেও অনুরুপ/কাছাকাছি ব্যাবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেভেলের শিক্ষকদের টিচিং ও গবেষণায় যথাক্রমে নূন্যতম ৬০% ও ৪০% হারে মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকা দরকার।
সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অবশ্যই স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (Educational Management and Leadership) ডিগ্রি থাকতে হবে। সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষানুরাগী শিক্ষক-শিক্ষাবিদ সদস্য, দাতা সদস্যের বাহিরে উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এ ছাড়া একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে কমিটিতে আওতাভুক্ত করা উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো Affiliating University-র মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন ও মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করা – যাতে যত্রতত্র কলেজ-মাদ্রাসা গড়ে উঠতে না পারে এবং দক্ষ গ্র্যাজুয়েট বের হতে পারে।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট মোকাবেলায় দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন, পরবর্তীতে শিক্ষা কমিশন গঠন অথবা জাতীয় করতে হবে। যেখানে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, দেশের শিল্প এবং শ্রমবাজারের সাথে পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেবলমাত্র নিদিষ্ট ভিশন ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। যদিও, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তবুও, সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রমের পথে এখনো বহু বাধা বিপত্তি রয়েছে, যা অনতিবিলম্বে, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি- এ তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিআইআইটি’র ডেপুটি ডিরেক্টর ড. সৈয়দ শহীদ আহমেদ, বিআইআইটি’র কো অর্ডিনেটর আনিসুর রহমান এরশাদ, বিআইআইটি’র সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর মো. লোকমান হোসাইন সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা) এর নেতৃবৃন্দ ও সদস্যবৃন্দ।
আশিক