ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

বিভক্তিতে বিপর্যস্ত ইবি ছাত্রদল, পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক

 ইবি সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

বিভক্তিতে বিপর্যস্ত ইবি ছাত্রদল, পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক

ছবিঃ সংগৃহীত

৫ আগস্টের পর মুক্তভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) রাজনীতি শুরু করে ছাত্রদল। তবে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ ও বিতর্ক। ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতেও রয়েছে গ্রুপিং ও বিতর্ক। ২০২০ সালের ১৬ জুন গঠিত তিন মাসের জন্য এই আহ্বায়ক কমিটির পেরিয়ে গেছে ৪ বছর। তাছাড়া পদপ্রাপ্ত বেশিরভাগ সদস্য নিষ্ক্রিয়, অছাত্র, বিবাহিত ও চাকরিজীবী। এ নিয়ে দলের মধ্যেই বাড়ছে অসন্তোষ। নিয়মিত ছাত্র ও তরুণদের মধ্য থেকে নেতৃত্বের দাবি জানাচ্ছে নেতা-কর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালে আহবায়ক কমিটি গঠনের পর থেকেই সংগঠনটির বর্তমান এই সংকটের শুরু। তখন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাহেদ আহম্মেদকে আহ্বায়ক ও ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের মাসুদ রুমী মিথুনকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। তবে কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত ও চাকরিজীবী সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করায় বিতর্কের মুখে পড়ে কমিটি।

তথ্য মতে, কমিটির যুগ্ম আহবায়কদের মধ্যে দুইজন বিবাহিত, দুইজন চাকরিজীবী ও নিষ্ক্রিয় এবং ছয়জন দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কার্যক্রমে আসেন না। এছাড়া সদস্যদের মধ্যে বিবাহিত একজন এবং চারজন রয়েছেন যাদেরকে সক্রিয় নেতাকর্মীদের কেউই চেনে না। এমন পরিস্থিতিতে কমিটি থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থানের আগে সংগঠনটির কার্যক্রমে ছিল স্থবিরতা। আন্দোলনকালীন সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠলেও এবং পরবর্তী সময়ে সংগঠনটি ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও কমিটির অর্ধেকেরও বেশি নেতা নিষ্ক্রিয় থাকায় দলীয় কর্মসূচিতে তাদের দেখা মেলে না। পদপ্রাপ্ত অধিকাংশ নেতাদের অনুপস্থিতিতে চলছে কার্যক্রম।

নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রলীগের দাপটে ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরে কোনো রাজনীতির সুযোগ পায়নি শাখা ছাত্রদল। ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী শেখপাড়ায় বিভিন্ন কার্যক্রম চালালেও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও হামলার শিকার হতে হতো। তবে অস্তিত্ব সংকটের সময়টিতেও বিভক্তি ছিল সংগঠনটিতে।

জানা যায়, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত ও চাকরিজীবী সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করায় কমিটি অনুমোদনের দিনই শাখা ছাত্রদলের একাংশ কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে। কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজের নেতৃত্বে কমিটিতে স্থান পাওয়া তার অনুসারীরা সংবাদ সম্মেলনে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি বাতিল না করলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন পারভেজকেই সদস্য সচিব করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো, কিন্তু তাকে বঞ্চিত করে বিবাহিত, অছাত্র, নারী কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ, আহসান হাবীব, সবুজ হোসাইন ও সদস্য সাব্বির হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে পারভেজ গ্রুপ কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় পদত্যাগ না করলেও তলে তলে বিভক্তি থেকে যায়। ফলে সংকটকালীন মুহূর্তেও আলাদাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন সাহেদ গ্রুপ ও পারভেজ গ্রুপ। গত ৫ আগস্টের পর তাদের সেই বিভক্তির রেখা আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে আলাদভাবে স্লোগান দিতে দেখা যায় গ্রুপ দুটিকে। বিভক্তির কারণে নতুন কমিটি গঠন নিয়েও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। উভয় গ্রুপ নিজেদের লোককে কমিটিতে আনতে বর্তমানে ‘শীতল যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ছাত্রত্ব না থাকলেও সভাপতি হতে মরিয়া শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ। বিভিন্ন জায়গায় চালাচ্ছেন তদবিরব। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ছাত্রত্ব টেকাতেও। একাডেমিক অর্ডিন্যান্সের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে মাস্টার্সে পুনঃভর্তির চেষ্টা করছেন। পারভেজের দাবি, পারিবারিক সমস্যার কারণে তার পড়াশোনা থেমে গিয়েছিল এবং সে জন্যই পুনঃভর্তি আবেদন করেছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একাডেমিক নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে তার ভর্তির অনুমোদন স্থগিত করে দেন উপাচার্য। বর্তমানে বিষয়টি একাডেমিক কাউন্সিলের বিবেচনাধীন রয়েছে।

এদিকে সংগঠনটির এমন সংকটময় অবস্থার ফলে হতাশা বিরাজ করছে নিয়মিত নেতাকর্মীদের মাঝে। অছাত্রদের বাদ দিয়ে নিয়মিত ছাত্রদের মধ্য থেকে নেতৃত্বের দাবি করছেন তারা। এ বিষয়ে ইবি ছাত্রদলের কর্মী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সাল থেকে আমি ছাত্রদলের সাথে সম্পৃক্ত আছি কিন্তু বর্তমান কমিটির পদপ্রাপ্ত সকলকে একসাথে হতে দেখিনি। এদের মধ্যে অধিকাংশই অনিয়মিত, অপরিচিত ও অছাত্র। আমরা অছাত্র, বিবাহিত, চাকরিজীবী ও নিস্ক্রিয় বাদ দিয়ে নিয়মিত ছাত্রদের নিয়ে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছি। না হলে আমরা এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করব। কেননা এভাবে চলতে থাকায় ইবি ছাত্রদলের গৌরব ক্ষুন্ন হচ্ছে।’

ইবি ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ বলেন, ১১ বছর পর দেওয়া আহ্বায়ক কমিটিতে পদপ্রাপ্ত অধিকাংশ নেতা অপরিচিত ও নিষ্ক্রিয়। এছাড়াও বিবাহিত ও চাকরিজীবী আছে। আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ তিন মাস থাকলেও প্রায় চার বছর পরও সম্মেলন বা নতুন কমিটি হয়নি। আমরা আশা করছি ইবি ছাত্রদলকে গতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল দ্রুতই ত্যাগী ও নির্যাতিতদের মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীবান্ধব কমিটির অনুমোদন দিবে।

গ্রুপিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে পারভেজ বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে সর্বোচ্চ এক বছর আমরা আলাদা ব্যানারে কার্যক্রম চালিয়েছিলাম। পরে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব আমাকেসহ কয়েকজনকে শোকজ করে। পরবর্তীতে কেন্দ্রের নির্দেশনায় আমরা একই ব্যানারে কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমাদের মধ্যে কোনো গ্রুপিং নেই। তবে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আছে। একে কর্মী সংগ্রহের প্রতিযোগিতাও বলা যেতে পারে।

এ বিষয়ে সংগঠনটির আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদ বলেন, সংগঠনের ভিতরে যারা গ্রুপিং করার চেষ্টা করছে তারা সরাসরি কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য করছেন। এই ধরনের কাজ সংগঠনকে অবমাননা করার শামিল। তাদের বিষয়টি আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রকে জানিয়েছি। এছাড়া সার্বিক বিষয়ে আমরা কেন্দ্রকে নিয়মিত অবহিত করছি। কেন্দ্র বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নিবে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি। দ্রুতই একটি সমাধানে আসবে। তবে কবে নাগাদ নতুন কমিটি সেটি বলা যাচ্ছে না।
 

আজাহারুল/জাফরান

×