ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

হালদা রক্ষায় সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ

সাফিনাতুন জাহান সাবরিন

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

হালদা রক্ষায় সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই চট্টগ্রাম। দক্ষিণ এশিয়ায় মিঠাপানির  মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননস্থলও চট্টগ্রামের হালদা নদীতে। তবে কালের আবহমানে  নেতিবাচক  নানাবিধ কারণে হারাতে বসেছে হালদা নদী ও নদীর জীববৈচিত্র্য। আমরা সবাই চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি আমাদের একাডেমিক এনভায়রনমেন্টাল রিপোর্টিং কোর্সের ফিল্ড ওয়ার্কের অংশ হিসেবে হালদা ভ্রমণ ও  সচেতনতামূলক ক্যাম্পেন করার সুযোগ হয়েছে। হালদা রক্ষায় জেলে, স্থানীয় জনসাধারণকে সচেতনতার পাশাপাশি হালদা পারের জেলেদের জীবন, নানা সংগ্রাম, এখানকার জীববৈচিত্র্য, প্রাণ-প্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ইত্যাদি জানা ও দেখা ছিল আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
আমাদের কোর্স শিক্ষক ও ব্যাচের ১০  শিক্ষার্থী আমরা হালদা ভ্রমণে অংশ নেই। সকাল ১১টায় আমরা রওনা হই। ঘণ্টাখানেকের কম সময়ের মধ্যেই আমরা হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা হালদার পাড়ে পৌঁছে যাই। দুটি নৌকা ভাড়া করে ২টি গ্রুপ নেমে পড়ি হালদার পানিতে। হালদার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। মূলত এসব ডিঙি নৌকা করে মানুষ যেমন  হালদার সৌন্দর্য উপভোগ করে, তেমনি প্রজনন মৌসুমে জেলেরা ডিম সংগ্রহ করে।
আমাদের ছোট ২টি ডিঙি নৌকা চলছে, হালদার জলাধারের সঙ্গে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে ডিগবাজি দিয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছে ২-১টি শুশুক। নৌকার বৈঠা চালাতে চালাতে মাঝিমাল্লাদের বিভিন্ন লোকজ গান, প্রাকৃতিক পরিবেশ, হিমেল হাওয়া আর পানির স্রোতের শব্দ অন্যরকম অনূভুতি তৈরি করে হালদা নদী। হালদা নদীকে স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়। মাছ ধরার পাশাপাশি মাছের ডিম সংগ্রহ এবং পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। হালদা বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ) নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।
তবে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, অবৈধভাবে মাছ শিকার, শিল্পকারখানার বর্জ্য, অবৈধ বালু উত্তোলন, নদীর বাঁক  কাটাসহ নানা কারণে হালদা নদীর পানিতে কমেছে  মাছের সংখ্যা। সেই সঙ্গে চরম হুমকির মুখে পড়ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য। হালদা রক্ষায় নেই তেমন কোনো পদক্ষেপ। তবে তরুণ প্রজন্ম যদি হালদার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে না জানে  কিংবা সচেতন না হয় সেক্ষেত্রে অচিরেই হারিয়ে যাবে চট্টগ্রামের সুখ ‘হালদা’। আমরা ১০ শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে যাই। আমাদের প্রতিটি প্ল্যাকার্ডে ছিল সচেতনতামূলক বার্তা। আমরা স্থানীয় জেলে, আশেপাশের জনসাধারণকে হালদা কেন গুরুত্বপূর্ণ ও হালদা রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করেছি।
হালদা পারের লোকজন ও জেলেদের  চোখেমুখেও আছে নানান সংগ্রামের গল্প। হালদা নদীর ওপর ভর করেই অসংখ্য মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। এখানকার জেলেরা জানান, হালদা নদীর প্রজনন সময় হচ্ছে এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাস। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে তিথি বলা হয়। স্থানীয় জেলেরা ডিম ছাড়ার তিথির পূর্বেই নদীতে অবস্থান নেন এবং ডিম সংগ্রহ করেন। ডিম সংগ্রহ করে তারা সারাদেশে বিভিন্ন  বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে বিক্রি করেন। হালদা শুধু একটি নদী নয়, এটি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। হালদা কেবল চট্টগ্রামের জলধারা নয়, এর সঙ্গে জুড়ে আছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অর্থনীতি। হালদার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গান, সিনেমা, লোকশিল্প। কোনো কারণে যদি হালদা নদী বিপন্ন হয়, তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাই বিপন্ন হবে। হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হালদা পারের মানুষদের সম্পৃক্ত এবং ডিম আহরণকারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং একই সঙ্গে হালদা পারের মানুষদের জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। হালদা নদী বাঁচলে দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকবে। হালদাকে বাঁচাতে সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

×