![মুক্তিযুদ্ধের একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ মুক্তিযুদ্ধের একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/Untitled-4-2501041349.jpg)
বালিগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। দেশে তখনও মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তবে টঙ্গিবাড়ি থানা, লৌহজং থানাসহ মুন্সিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) অধিকাংশ থানা হানাদারমুক্ত হয়েছে। মুক্ত অঞ্চলে প্রশাসন পরিচালনা করছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমার ভীষণ জ্বর হয়। জ্বরের কারণে সাতদিনের ছুটি নিয়ে আবদুল্লাহপুর থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। গ্রুপ কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন ও সাখাওয়াত হোসেনসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আমাকে দেখতে আসেন। পরের দুই-তিন দিনেই জ্বর ভালো হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে বসে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম। দেশ স্বাধীনের পর কী করবোÑ এ নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা শুরু করি। আমাদের বন্ধু মোফাজ্জল হোসেন গ্রামে থাকবে বলে জানায়। আর আমি ও অপর বন্ধু সাখাওয়াত হোসেন পুনরায় পড়াশোনা করার পাশাপাশি গ্রামের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করবো বলে সিদ্ধান্ত নেই।
বালিগাঁও আমাদের জন্মভূমি। এই গ্রামকে আমরা প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। গ্রামের উন্নয়ন করতে হবে, এ ব্যাপারে আমরা তিনজনই একমত। আমরা তিনজন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারবে না আমাদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ। আমরাও আমাদের ইউনিয়নে ডা. সৈয়দ বাবর হোসেনকে (সাবেক পরিচালক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ) দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন গড়ে তুলেছি। আমাদের সিদ্ধান্তে স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা করবেÑ এই বিশ্বাস আমাদের আছে।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটলো। এ পরিবর্তন একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের মনেও দাগ কাটে। আমাদেরকেও নতুন নতুন কিছু করার প্রেরণা জোগায়। মুক্তিযুদ্ধ আমার মনে দুটি আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে। একটি হচ্ছে বালিগাঁওয়ে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা। আর দ্বিতীয়টি হলো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে হাতে লিখে আমরা পত্রিকা প্রকাশ করতাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর ঐ সাপ্তাহিক পত্রিকা আবার প্রকাশ করার উদ্যোগ নেই।
অনেক দিন থেকেই বালিগাঁওয়ে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার কামনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের কারণে সেই সুযোগ হাতের নাগালে এসে গেল। আমাদের ইউনিয়নের নাম আড়িয়াল-বালিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ হলেও এখানে একটিমাত্র হাইস্কুল ছিলো; তাও ইউনিয়নের এক প্রান্তে। বালিগাঁওয়ে ইউনিয়ন পরিষদের অফিস ছিলো। কিন্তু তহশিল অফিস ছিলো আড়িয়ালে। হাইস্কুল ছিলো আড়িয়ালে। এই অবস্থায় রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আড়িয়াল স্বর্ণময়ী হাইস্কুলে যেতে হতো।
প্রধানত তিনটি কারণে বালিগাঁয়ে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিলো। এক. স্কুলের দূরত্ব : বালিগাঁও থেকে আড়িয়ালের দূরত্ব বেশ খানিকটা। রোদবৃষ্টি-ঝড় মাথায় নিয়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অসম্ভব ছিলো। স্কুল কাছাকাছি হলে ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের কষ্ট লাঘব হবে। ছাত্রছাত্রীরা সহজেই স্কুলে যেতে পারবে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়বে। দুই. কাজিরগাঁও, নয়াগাঁও, ইসলামপুর, খিতিরপাড়া, বামুদিয়া, ভোরন্ডা, আপরকাটি ও বালিগাঁওয়ের ছাত্রছাত্রীরা সহজেই বালিগাঁও স্কুলে পড়তে পারবে। এতে নতুন স্কুলের শিক্ষার্থীসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তিন. ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ : আড়িয়ালের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আড়িয়াল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষকরা অন্য এলাকার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতো। এসব কারণে আড়িয়াল হাইস্কুলের প্রতি অন্য এলাকার ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ ছিল।
এখানে একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। আড়িয়াল স্কুলের শিক্ষক শহীদুল হক (সাবেক এমপি শামসুল হকের ছোটভাই) টিফিনের পর ক্লাসে ঢুকতে দেরি হওয়ার কারণে আমাকে ও চৌধুরী শহিদুল হককে (পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন) বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তখন আমরা দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনায়ও আমরা ভালো ছিলাম। সকল ছাত্রছাত্রীর সামনে এই অপমান আমার কাছে আজও পীড়াদায়ক। এসব কারণে বালিগাঁওয়ে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর মুক্তিযুদ্ধ সেই স্কুল প্রতিষ্ঠার সুযোগ এনে দেয়। সেই সুযোগটাই আমরা গ্রহণ করি। এসব কারণে স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রথম চিন্তা আসে আমার মনে। এ ব্যাপারে প্রথমে বন্ধু সাখাওয়াতের সঙ্গেই আলোচনা করি। সাখাওয়াত একমত হলে বিষয়টি তোফাজ্জলকে জানাই। মোফাজ্জল বিষয়টি সম্পর্কে আপত্তি না জানিয়ে বলে, ‘সামলাতে পারবি তো!’ জবাবে আমরা বললাম, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সবাই এক থাকলে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা কোনো কষ্টের কাজ হবে।’
আমরা তিনজন একমত হওয়ার পর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করি। এই প্রশ্নে সকলের সঙ্গেই আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথমে আড়িয়াল স্বর্ণময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুলতান হালদার, প্রাইমারি (বালিগাঁও) স্কুলের শিক্ষক খোকা মাস্টারের (জয়নাল আবেদিন খোকা) সঙ্গে আলোচনা করি। পরবর্তীতে আড়িয়াল স্বর্ণময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তারিনী মণ্ডল, আমার বাবা আড়িয়াল স্কুলের শিক্ষক হিমাংশুভূষণ দাশগুপ্ত এবং ঐ স্কুলের অপর শিক্ষক খায়রুল আলমের সঙ্গে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কথা বলি। সকলের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন স্কুলের জন্য খাতাপত্র তৈরি করি আমি ও সাখাওয়াত।
বাসায় বসে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের রশিদ কাটি। পরে তাঁদের কথায় ও পরামর্শে শিক্ষা অফিস থেকে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠার আবেদন ফরম সংগ্রহ করি। শিক্ষা অফিস থেকে হাজিরা খাতা ও হিসাবের খাতার নমুনা সংগ্রহ করে এগুলো কিনে আনি। স্কুল প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি সম্পর্কে গ্রুপ কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেনকে জানাই আমি ও সাখাওয়াত। আমরা তিনজন এ ব্যাপারে একমত হলে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আবেদনপত্র জমা দেবার সিদ্ধান্ত নেই। আবেদনপত্রের সঙ্গে স্কুল পরিচালনার জন্য একটি কমিটি জমা দিতে হবে। এসময় সাত সদস্যের পরিচালনা কমিটি গঠন করি আমরা তিনজন।
এই কমিটিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন। কমিটিতে আমি ছিলাম; মোফাজ্জল হোসেন, সুলতান হালদার, হিমাংশুভূষণ দাশগুপ্ত, জয়নাল আবেদিন খোকা ও লাল মিয়া ছিলেন। আবেদনপত্রের সঙ্গেই ছাত্র-ছাত্রীদের নাম, তাদের নামে বেতনের রশিদ, আয়-ব্যয়ের খাতাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে জমার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আর এই মুহূর্তে অস্থায়ীভাবে বিদ্যালয়ের ক্লাস হবে কুমুদিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমরা হাইস্কুলের জন্য আলাদা জায়গা চূড়ান্ত করছি বলে অঙ্গীকার জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করলাম। এই সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে ও সাখাওয়াত মহকুমা শিক্ষা অফিসে জমা দিলাম। উল্লেখ্য, খাতাপত্র ক্রয় করার জন্য আমি ও সাখাওয়াত দুজনে ৫০ টাকা করে মোট ১০০ টাকা স্কুলের তাহবিলে জমা দেই। স্কুলের ক্লাস শুরুর চক-ডাস্টার ও কাগজপত্র করার জন্য আমরা চারজন তৎকালীন শিক্ষকদের প্রত্যেককে ১০ টাকা করে চাঁদা দিতে বলি। এই চারজন শিক্ষক হলেন আব্দুল বারেক মাস্টার, আবদুল গনি, জয়নাল আবেদিন খোকা ও তারা মাস্টার; আমাদের শ্রদ্ধেয় এই চার শিক্ষক ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ৬ মাস পর্যন্ত এই চাঁদা প্রদান করেছেন।
আবেদনপত্র জমা দেবার পর ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি স্কুলের ক্লাস শুরু করি বালিগাঁও কুমুদিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রথম ক্লাসে যেয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শিক্ষার্থীদের কাছে স্কুল প্রতিষ্ঠার পটভূমি ব্যাখ্যা করে নতুন স্কুলে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহের অনুরোধ জানাই।