
বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের সুঘ্রাণে মাতে শিক্ষার্থীরা
বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের সুঘ্রাণে মাতে শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকে স্কুল ইউনিফর্ম নিয়ে ভিড় জমায় স্কুলে। দিন শেষে নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফেরে তারা। কিন্তু এবার বছরের শেষ দিকে দরপত্র বাতিল, পুনঃদরপত্র, শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগে গাফিলতি হয়েছে। এমন হাফ ডজন কারণে বছরের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিতে পারছে না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে মাত্র ৬ কোটি বই ছাপা হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হতে পারে।
পরিবহন ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া ও সার্বিকভাবে বই ছাপানো না হওয়াই এর জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব কারণে প্রেস মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ ও দীর্ঘ বৈঠক ও বচসাও হয়েছে বেশ। কিন্তু এরপরও বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে বই না দেওয়ার দায় নিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, নতুন বই পেতে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতেই হবে। বছরের শুরুতে প্রাথমিকের তিনটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পাবে। তবে চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানো শেষ হয়নি। মাধ্যমিকের কোনো শ্রেণির বই ছাপা সহসাই শেষ করা সম্ভব নয়।
যে কারণে বছরের প্রথম দিন ওয়েবসাইটে সব শ্রেণির বই আপলোড করা হচ্ছে। অর্থব্যয় কমাতে বই উৎসব বাদ রাখা হলেও শিক্ষা উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নতুন পাঠ্যবই উদ্বোধন করবেন। সূত্র জানায়, ৩২৩ উপজেলায় বই ছাড় করা হয়েছে মাধ্যমিকের। প্রাথমিকের বই ৪০০ উপজেলায় যাবে। প্রাথমিকে বই ছাপা হয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ। মাধ্যমিকে ২ কোটি ৮ লাখ।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই। মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। তাছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হবে।
ছাপাখানার মালিক, মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও এনসিটিবি সূত্র জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম ও দশম শ্রেণির
সবমিলিয়ে ৬ কোটির মতো বই ছাপা হয়েছে। তবে ছাপা হলেই তো আর হবে না। বইগুলোকে স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্টরা জানান, সব স্কুলে বই যেতে নির্ধারিত বিতরণে পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপরও অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে। যেখানে জেলা থেকে পৌঁছাতেই দুই-তিনদিন সময় লাগে।
সেসব এলাকায় আরও চারদিন সময় লাগতে পারে। তবে বইয়ের জন্য যেভাবে বিরামহীন ছাপাখানা চলছে, তেমনি নির্ঘুম এনসিটিবি কর্মকর্তারা। কিন্তু সময় কম থাকা, কাগজের কৃত্রিম সংকট ও কার্টিজ পেপারের স্বল্পতা রয়েছে। যে কারণে চীন থেকে বিমানে কার্টিজ পেপার উড়িয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, ৬ কোটির বেশি বই ছাপা ও বাঁধাই শেষ হয়েছে। ১ জানুয়ারি সব শ্রেণির দুই থেকে তিনটি করে বই দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। কিন্তু মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলছেন উল্টো কথা। তারা জানান, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই শিক্ষার্থীদের হাতে যাবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কাজ শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের শেষের দিকে। এনসিটিবি বলছে প্রাথমিকের সব বই যাবে। মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই প্রথম দিন পৌঁছানো হবে। সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এনসিটিবির বিতরণ শাখা জানায়, প্রতিটি উপজেলায় বই পৌঁছানের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন কোনো উপজেলায় ষষ্ঠ শ্রেণির দুটি-তিনটি করে বই পাঠানো হবে। অন্য উপজেলায় হয়তো সপ্তমের বই দেব। আবার কোনো উপজেলায় দশম শ্রেণির দুটি করে বই দেওয়া হবে। এভাবে সব উপজেলায় কিছু বই যাবে। কিন্তু ১ জানুয়ারি কোন কোন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পাবে, আর কোন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পাবে না; তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় শিক্ষক-অভিভাবকরা।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ৬৫৫টি বই সংশোধন-পরিমার্জন করতে হয়েছে। সব শ্রেণির বইয়ের পা-ুলিপি নতুন করে করা। তা ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে গল্প-গ্রাফিতি নির্বাচন করে বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে। এসব করতে বড় একটা সময় লেগে গেছে। আবার অন্যবার ৩০-৩২ কোটির মতো বই ছাপানো হয়। এবার বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি; প্রায় সোয়া ৪০ কোটি।
বই হাতে না পেলেও মিলবে অনলাইনে ॥ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা জানুয়ারি মাসে বই পেতে পারে। সব না হলেও আংশিক বই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বই না পেয়ে ক্লাস শুরু করা নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বছরের প্রথমদিনে সব শ্রেণির বইয়ের পিডিএফ কপি ওয়েবসাইটে আপলোড করে দেবে এনসিটিবি। সেখান থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা বইয়ের পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে নিতে পারবে। প্রয়োজনে কিছু অংশ প্রিন্ট করে পড়তে পারবে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানান, মাধ্যমিকের বই দিতে আমাদের দেরি হবে। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সব বইয়ের পিডিএফ আপলোড করা হবে। কেউ চাইলে সেখান থেকেও সহযোগিতা নিতে পারবেন। এখন সবার বাড়িতে কম্পিউটার মোবাইল, ইন্টারনেট রয়েছে। বই পেতে যাদের কিছুটা দেরি হবে, তারা অনলাইন থেকে পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করে প্রাথমিকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবে। প্রয়োজনে প্রথম দু-তিনটি অধ্যায় প্রিন্ট করেও পড়তে পারবে তারা। শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
‘বই উৎসব’ বাতিল হবে বই উদ্বোধন ॥ বিনামূল্যে বছরের শুরুতে বই দেওয়া শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বিগত ১৫ বছর বছরের প্রথমদিনে সরকার ঘটা করে বই উৎসব করত। ১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করতেন। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি স্কুলে বড় অনুষ্ঠান করত। তা ছাড়া বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা, পৌরসভা পর্যায়ে ঘটা করে বই বিতরণে অনুষ্ঠান করা হতো।
বই উৎসব ঘিরে বড় অংকের অর্থ বাজেট করত সরকার। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ঘটা করে বই উৎসব করবে না। রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার বিশেষ সহকারী ড. এম আমিনুল ইসলাম উপস্থিত থেকে বই উদ্বোধন করবেন।
বাড়ছে কাগজের মান-উজ্জ্বলতা ॥ এবার বই ছাপার কাজে দেরি হলেও কাগজ ও ছাপার মান ঠিক রাখতে কঠোর এনসিটিবি। বিগত বছরগুলোতে পাঠ্যবইয়ের কাগজের ওজন ৭০ গ্রাম রাখা হতো। তাতেও ফাঁকি দিতেন ছাপাখানা মালিকরা। নি¤œমানের কাগজের কারণে বছরের শুরুতেই নষ্ট হয়ে যেত বই। অনেক শিক্ষার্থীর চোখেও হয় সমস্যা। যে কারণে এবার কাগজের ওজন বাড়িয়ে ৮০ গ্রাম করেছে সরকার। তাছাড়া উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে ভার্জিন পাল্প ব্যবহারের বিষয়। মলাটের আর্ট কার্ড বিদেশ থেকে আমদানিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি ও ব্যবসায়ীরা।