কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে। সম্প্রতি, এআই-এর একটি নতুন দিক হিসেবে বিশ্ব মডেল বা ‘ওয়ার্ল্ড মডেল’-এর ধারণাটি প্রযুক্তি জগতে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। গবেষকরা মনে করছেন, এটি ভবিষ্যতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। এই প্রবন্ধে, আমরা এআই বিশ্ব মডেল কি, এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটি কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও বাস্তবজীবনের সমস্যাগুলো সমাধানে ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বিশ্ব মডেল বা ওয়ার্ল্ড সিমুলেটর
বিশ্ব মডেল, যা অনেক সময় ‘ওয়ার্ল্ড সিমুলেটর’ নামেও পরিচিত, হলো এমন এক ধরনের এআই পদ্ধতি যা পৃথিবীর কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অভ্যন্তরীণ ধারণা তৈরি করতে পারে। এটি মানুষের মস্তিষ্কের মডেল তৈরির ক্ষমতা থেকে অনুপ্রাণিত। আমাদের মস্তিষ্ক বাস্তব জগতের তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা থেকে ধারণা গঠন করে, যা আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং ভবিষ্যতের ঘটনা অনুমান করতে সাহায্য করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একজন বেসবল খেলোয়াড়ের কথা। খেলোয়াড়টি বলটি কোথায় পড়বে তা অনুমান করে মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ডে ব্যাট চালান। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে খেলোয়াড়ের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এআই গবেষক ডেভিড হা এবং জার্গেন স্মিডহুবার-এর গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, খেলোয়াড়দের এই ক্ষমতা তাদের অভ্যন্তরীণ মডেলের কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে।
কার্যকারিতা
বিশ্ব মডেলের মূল কাজ হলো বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলো সম্পর্কে একটি অভ্যন্তরীণ ছবি বা মডেল তৈরি করা। এটি সাধারণত ছবি, ভিডিও, শব্দ, এবং পাঠ্য তথ্যের বিশাল ডেটাসেট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এই মডেলটি শুধু দৃশ্যমান ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি করে না; বরং এটি একটি গভীরতর ধারণা গঠন করে, যা ভবিষ্যতে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বল কেন বাউন্স করে, তা বুঝতে একটি বিশ্ব মডেল শুধু বলের গতি পর্যবেক্ষণ করে না, বরং বলের ভর, আকৃতি এবং বলের উপর প্রভাব ফেলা বাহ্যিক শক্তিগুলোও বোঝার চেষ্টা করে।
ব্যবহার
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, বিশ্ব মডেল ভিডিও তৈরি এবং সম্পাদনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সাধারণত, এআই-নির্মিত ভিডিওতে অসঙ্গতি দেখা যায়, যেমন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভুল নড়াচড়া। কিন্তু একটি শক্তিশালী বিশ্ব মডেল বাস্তব জগতের কার্যপ্রণালী বুঝে এমন ভিডিও তৈরি করতে পারে যা আরো বাস্তবসম্মত। সিমুলেশন এবং পূর্বাভাস: বিশ্ব মডেল বিভিন্ন ঘটনা পূর্বানুমান করতে এবং কার্যকর পরিকল্পনা করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, একটি মডেল যদি একটি অগোছালো ঘরের ভিডিও দেখে, তবে এটি কিভাবে ঘরটি পরিস্কার করা যেতে পারে তার একটি সঠিক পরিকল্পনা দিতে পারে। এটি শুধু পূর্বে দেখা ডেটার পুনরাবৃত্তি নয়, বরং গভীর ধারণার ভিত্তিতে কাজ করে। গেমিং জগতে বিশ্ব মডেল বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বর্তমানে, ভার্চুয়াল জগত তৈরিতে প্রচুর সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু বিশ্ব মডেলের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি সম্পূর্ণ ৩ডি জগত তৈরি করা সম্ভব হবে, যা ইন্টারঅ্যাকটিভ এবং প্রাণবন্ত। রোবটগুলো সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কাজ করতে পারে, কারণ তারা বাস্তব জগত সম্পর্কে সচেতন নয়। বিশ্ব মডেল রোবটগুলোকে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি উন্নত বিশ্ব মডেল রোবটকে একটি অজানা পরিবেশে নিজের কাজ সম্পাদনে সহায়তা করতে পারে।
চ্যালেঞ্জ
বিশ্ব মডেলগুলোর উন্নয়নে এখনও অনেক বাধা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো: ১। বিশ্ব মডেল তৈরি এবং পরিচালনা করতে বর্তমান এআই মডেলের তুলনায় অনেক বেশি কম্পিউটিং শক্তি লাগে। উদাহরণস্বরূপ, ওপেনএআই-এর সোরার মতো মডেল চালাতে হাজার হাজার জিপিইউ দরকার হয়।
২। বিশ্ব মডেল তৈরির জন্য ডেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বৈচিত্র্যময় এবং সুনির্দিষ্ট ডেটার অভাব দেখা যায়। যদি একটি মডেল শুধু নির্দিষ্ট ধরনের ডেটা থেকে প্রশিক্ষিত হয়, তবে এটি বিভিন্ন পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি মডেল শুধুমাত্র ইউরোপীয় শহরের ভিডিও দেখে প্রশিক্ষিত হয়, তবে এটি কোরিয়ান শহরের বরফপূর্ণ পরিবেশ ঠিকভাবে বোঝার ক্ষমতা হারাতে পারে।
৩। যেকোনো এআই মডেলের মতো, বিশ্ব মডেলগুলোও প্রশিক্ষণ ডেটার উপর নির্ভরশীল। পক্ষপাতপূর্ণ বা অসম্পূর্ণ ডেটা ব্যবহারে মডেলটি ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
যদিও বিশ্ব মডেল এখনো বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এটি এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, বিশ্ব মডেল কেবল ভার্চুয়াল জগত তৈরি নয়, বাস্তব জগতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানেও কার্যকর হতে পারে।
তথ্য সূত্রঃ টেকক্রাঞ্চ