ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের ক্রমবর্ধমান হার নিয়ে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের গবেষণায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে লেখক মো. আকিব জামান উল্লেখ করেছেন যে, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ, বন্ধুদের প্রভাব, গণমাধ্যমে প্রচারিত সহিংস বিষয়বস্তু এবং স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নেতিবাচক ভূমিকা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ।
এতে কিশোর অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ১৮ বছরের কম বয়সী অপ্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম হিসেবে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, একটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ তার পারিবারিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আধুনিক কর্মজীবী বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে শিশুরা পরিবার থেকে পর্যাপ্ত মনোযোগ পাচ্ছে না। জন বোলবির মাতৃত্ববঞ্চনা তত্ত্ব অনুসারে, শৈশবে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অভাব শিশুর মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে শিশুরা পারিবারিক সংযোগের অভাবে স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত ডিভাইসের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এসব অভ্যাস তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এবং অপরাধের দিকে ধাবিত করছে।
সামাজিক পরিবেশও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, মাদকের সহজলভ্যতা, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা কিশোরদের অপরাধমূলক কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করছে। রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজে একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে, যা শিশুদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলছে।
গবেষণায় বন্ধুবান্ধব বা সহপাঠীদের প্রভাবকে কিশোর অপরাধের আরেকটি প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বন্ধুরা একটি শিশুর মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন্ধুর নেতিবাচক আচরণ বা অভ্যাস একজন শিশুকে সহজেই অপরাধের পথে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশু বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধূমপানের মতো অভ্যাস শুরু করতে পারে, যা পরে বড় ধরনের অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
গণমাধ্যমে প্রচারিত সহিংস বিষয়বস্তু কিশোরদের অপরাধে উদ্বুদ্ধ করার আরেকটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে জনপ্রিয় অনেক অ্যাকশন ফিল্ম বা সিরিজ সহিংসতা, মাদকসেবন এবং ধূমপানের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে।
উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশি সিনেমা তুফান-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা সমালোচকদের মতে সহিংসতা এবং মাদকসেবনের অপ্রয়োজনীয় প্রদর্শন করেছে। এই ধরনের বিষয়বস্তু শিশুদের মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং তাদের অপরাধমূলক কাজে প্ররোচিত করছে।
স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকাও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমাজের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশেষ করে রাজনীতিবিদ বা নেতিবাচক মনোভাব সম্পন্ন বয়োজ্যেষ্ঠরা শিশুদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রভাবশালীরা শিশুদের তাদের মতো আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে, যা অপরাধে জড়ানোর একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এ প্রসঙ্গে মো. আকিব জামানের মত, "কিশোর অপরাধ বাংলাদেশের একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। এটি সমাধান না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি গভীর সংকটে পড়বে।" তিনি আরও বলেন, "সরকার, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমকে একত্রে কাজ করতে হবে। শিশুদের সুরক্ষা এবং তাদের মানসিক বিকাশের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।"
এতে সুপারিশ করা হয়েছে, কিশোর অপরাধ রোধে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি গণমাধ্যমের সহিংস বিষয়বস্তু প্রচার বন্ধ করা, শিশুদের মানসিক বিকাশে পারিবারিক ভূমিকা জোরদার করা এবং বন্ধুবান্ধব ও সামাজিক পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যদি এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চরম সংকটের মুখোমুখি হবে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
মেহেদী কাউসার