ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

বছরের প্রথম দিন বই দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা

আসিফ হাসান কাজল 

প্রকাশিত: ১৩:৪৮, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বছরের প্রথম দিন বই দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা

মাধ্যমিকের নতুন বই

ডিসেম্বর প্রথম সপ্তাহ শেষ। এই সময় উপজেলা পর্যায়ে ৪০ শতাংশ বই চলে যায়। তবে এবার নবম শ্রেণির পাঠ্যবই মুদ্রণে দরপত্রই সম্পন্ন হয়নি। দশম শ্রেণির দরপত্র শেষ হলেও বাকি একাধিক কার্যক্রম। একই অবস্থা অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রেও। ছাপা শুরু হয়নি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইও। এর মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে কাগজ সংকট। তাদের অভিযোগ, কাগজ মিলগুলোকে অগ্রিম টাকা দিয়েও কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জানুয়ারির এক তারিখ প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে বই চলে যাবে। তবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা।

দরপত্র আহ্বান থেকে বই ছাপাখানায় যেতে হয় একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেই নিয়মের চক্করে বই মুদ্রণে যেতেও সময় লাগছে বেশি। প্রতিবছর এই প্রক্রিয়া বছরের মাঝামাঝি শুরু হলেও এবার নানা কারণে শেষ দিকে শুরু হয়। যার ফলে পরিস্থিতি বিবেচনায় সময় যে বেশি লাগবে তা ব্যবসায়ী বুঝলেও তবে বুঝতে চাচ্ছে না এনসিটিবি এমনটাই অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়, পাঠ্যবই ছাপায় যুক্ত হতে ব্যবসায়ীরা প্রথমে দরপত্রে অংশ নেয়। যিনি সর্বনিম্ন দরদাতা হন তার দরপত্র মূল্যায়ন করে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। যাচাই-বাছাই শেষে সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের ক্রয় কমিটির অনুমোদনের পর সেটি যায় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে। সেখান থেকে প্রয়োজন হয় সম্মতির। এরপর নোটিফিকেশন এওয়ার্ড (নোয়া) দেওয়া হয়। শুরু হয় চুক্তির মাধ্যমে কাজ। তবে সেখানেও একটি জটিলতা রয়েছ। ব্যবসায়ীরা জানান, নোয়া পাওয়ার পর এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। ১৪ দিনের মধ্যে যতটাকার কাজ পেয়েছে তার পারফরমেন্স গ্যারান্টি (পিজি) হিসেবে জমা দিতে হয় কাজের ১০ শতাংশ অর্থ। চুক্তির জন্য ২৮ দিন সময় পান তারা। পিপিআরের শর্ত অনুযায়ী চুক্তির পর ৪০ দিন সময় পান মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। এরমধ্যেই বই ছেপে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুস্তক ব্যবসায়ী অভিযোগের সুরে জানান, বই ছাপানোর কাজ জুন মাস থেকে শুরু হলেও এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও কারিকুলাম সংশোধনের কারণে অনেক দেরি হয়েছে। এসব কারণে দরপত্র শুরু করতেই সময় নেয় এনসিটিবি নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। এছাড়াও এনসিটিবিতে সব নতুন কর্মকর্তা আসায় তাদের কাজ বুঝতে সময় লাগছে। যেকারণে পুরো প্রক্রিয়ার ওপর এর একটি প্রভাব পড়েছে। এবছর এখনো বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে কোন ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দেয়নি বোর্ড। এর ফলে কাগজের মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ নিয়েও ভুগতে হচ্ছে। এনসিটিবি কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের কাছে ছাপার কাগজ চেয়েছেন। সেটি কোন ল্যাবে পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেবেন বলে জানা গেছে। এসব একাধিক কারণ দ্রুত বই ছাপায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। 

ব্যবসায়ীদের অভিযোগগুলো যে অসত্য নয় সেটি স্বীকার করেছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান। কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে নিয়ম ভেঙ্গে কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন তিনি।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৪ কোটি বই ছাপানো হয়েছে। যা মোট বইয়ের ১০ শতাংশ। এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, দ্রুত যেন বইয়ের কাজ শেষ হয় একারণে পারফরমেন্স গ্যারান্টি (পিজি) নেওয়া হচ্ছে না। বইয়ের তদারকি এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া না হলেও এ বিষয়ে কাজ করছে নিজস্ব মনিটরিং কমিটি। তারা ব্যবসায়ীদের থেকে কাগজ সংগ্রহ করে কাগজের মান নির্ণয় করছেন।

চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, এই দুই শ্রেণির বই ছাপানোর অনুমোদন আটকে আছে। আমরা আশা করছি। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকেই এটি ছেড়ে দেওয়া হবে। 

অষ্টম শ্রেণির দরপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, এনসিটিবির কাজ শেষ। বাকী কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। এক্ষেত্রে আমাদের হাতে কিছু নেই। দ্রুত কাজ বের করার তাগিদ আমরা তাদেরকে দিচ্ছি। নবম শ্রেণির বিষয়ে তিনি জানান, এটি খুব ক্রিটিকাল অবস্থায় আছে। আবার দশম শ্রেণির বিষয়েও জটিলতা রয়েছে। কারণ, ২০২৬ সালে যারা এসএসসি পরীক্ষা দিবে তারা নবম শ্রেণির বই পড়েছেন নতুন কারিকুলামে। আবার দশম শ্রেণির বই পড়বে সৃজনশীল কারিকুলামে। এসব কারণে আগামীর এসএসসি পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অনুযায়ী কাজ করছে এনসিটিবি। 

তিনি আরও জানান, এবার বই উৎসব হবে না। অনলাইনে পাঠ্যবই দেওয়া থাকবে। আর কোন বছরই তো বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদেরকে সব বই দেওয়া হয় না। নবম ও দশম শ্রেণির বই ছাপাতে দেরি হলেও আমরা কিছু বিষয়ের বই ছাপিয়ে হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেব। যাতে শ্রেণি কার্যক্রমে কোন প্রভাব না থাকে। 

বই ছাপাতে দেরির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে কারিকুলাম সংশোধনসহ নানা বিষয় পরিমার্জন করা হয়েছে।

জানা যায়, গত বছর বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপতে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ বছর ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে ছাপার ব্যয় বৃদ্ধি ৭০০ কোটি। তবে এর জন্য কাগজের দাম বৃদ্ধি ও ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যাওয়া ও মুদ্রাস্ফিতি বড় কারণ বলে মনে করছেন মুদ্রাকররা। তারা জানান, গত বছর ছাপা হয় প্রায় ৩৪ কোটি, কিন্তু এ বছর ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ পাঠ্যবই। এরমধ্যে ১০ কোটি প্রাথমিকের বই। নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিকে বিষয় ছিল ১০টি, কিন্তু আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ায় বই হয়ে যাচ্ছে ১৩টি। এ ছাড়া দশম শ্রেণির জন্য এবার বিশেষভাবে বই করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বই বেশি ছাপতে হচ্ছে। এতে প্রায় ৪০০-৪৫০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। 

এবার কাগজের দাম প্রতি টন প্রায় এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে প্রতি ফর্মা কাগজের দাম পড়েছে অন্তত এক টাকা ৯৪ পয়সা, কাভারের দাম ২৫ পয়সা, প্রিন্টিং ১২ পয়সা, বাইন্ডিং ১৫ পয়সা, কাভার ইউভি বা প্রিন্টিং পাঁচ পয়সা, পরিবহন খরচ পাঁচ পয়সা, ব্যাংক ইন্টারেস্ট আট পয়সা এবং ট্যাক্স বাবদ দিতে হয় ২১ পয়সা। ফলে সব মিলিয়ে প্রতি ফর্মার পেছনে খরচ হয় দুই টাকা ৮৫ পয়সা। আর মাধ্যমিকে প্রতি ফর্মার রেট দেওয়া হয়েছে তিন টাকা বা এর সামান্য কমবেশি। তবে প্রাথমিকে ফোর কালার প্রিন্টিং এবং ৮০ জিএসএম কাগজ হওয়ায় সেখানে রেট আরো কিছুটা বাড়িয়ে তিন টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৪৫ পয়সা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। যেখানে গত বছর কাগজের টন ছিল ৯০ হাজার টাকা, ব্যাংক ইন্টারেস্ট ছিল ৯ শতাংশ। এবার ব্যাংক সুদহার ১৭ শতাংশে যেয়ে ঠেকেছে।
 
পাঠ্যবই নিয়ে মুদ্রাকর-এনসিটিবির আস্থার সংকট \ বিগত বছরগুলোতে নি¤œমানের পাঠ্যবই সরবরাহ করেও পার পেয়ে যেতেন পুস্তক ব্যবসায়ীরা। তবে এবার প্রতিটি প্রদক্ষেপে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। কাগজের মান খারাপ বা ছাপায় ক্রুটি পেলে এনসিটিবি জরিমানাসহ বই কেটে ফেলছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এনসিটিবির অনেক কর্মকর্তা পাঠ্যবই ছাপানোর সঙ্গে আগে থেকে জড়িত ছিলেন না। তাদের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা কম। এসব কারণে মাঠ তদন্তে বেশি মাত্রায় শাস্তি পেতে হচ্ছে।

এবার প্রাথমিকের চার রঙ্গা বইয়ের উজ্জ্বলতা ৮৫ জিএসএম (গ্রাম পার স্কোয়ার মিটার) ও মাধ্যমিকের ৮২ জিএসএম দরপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। বিগত সময়েও এমন ছিল। কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন ছিল না। যেকারণে  সরকারি এসব বই ৬ মাস ৮ মাসেই পড়ার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু এবার এসব বিষয়ে কোন ছাড় দিচ্ছে না এনসিটিবি। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশের যেসব কাগজ কল আছে সেসববের ম্যাশিন অনেক পুরাতন। ৮৫ জিএসএমের কাগজে ভার্জিন পাল্প ব্যবহার হয়ে থাকে। বিগত বছরে অনেকে সেটি না মানলেও এবার তা মানতে হচ্ছে। কিন্তু কাগজকলগুলো কম্পিউটারাইড না থাকার কারণে বড় কাগজে কোথাও ৮০ জিএসএম আবার কোথাও ৮২ জিএসএম আবার কোথাও ৮৫ জিএসএমের বেশি পাওয়া যাচ্ছে। কারিগরি এই ত্রুটিতে কোন বইয়ের কাগজের জিএসএম ৮৫ কম পাওয়া গেলেই এনসিটিবি শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু শাস্তিটি এমন যে প্রায় ২৪ টন কাগজের বই কেটে ফেলা হচ্ছে। যা পিপিআরের শর্ত ভঙ্গের শামিল। এসব কারণে অনেক ব্যবসায়ী কাজ পেয়েও চুক্তি করতে অস্বস্তি প্রকাশ করছে। 

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান জানান, শিট মেশিনে বই ছাপা হলে প্রথম পর্যায়ের বইয়ের কাগজে ছিদ্র হয়। এমনটা আমাদের নতুন কর্মকর্তারা অবগত ছিলেন না। আবার ছাপাখানার সব মেশিনে একই রকম ছাপা হয় না। এসব বিষয়ে মনিটরিংয়ে যেয়ে কিছু ভুলবোঝাবুঝি হয়েছিল। তবে সব সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। দূরত্ব যেন না থাকে সেকারণে কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

এম হাসান

×