স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজ (বিওটি) চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ। এর বাইরে সদস্য রয়েছেন ৯ জন। যার মধ্যে দুইজন ফাতিনাজ ফিরোজের মেয়ে ফারহানাজ ফিরোজ ও জারাহনাজ ফিরোজ। বাকি সাতজনের মধ্যে আরও দুইজন পরিবারটির নিকট আত্মীয়। এরমধ্যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাকি একাধিক সদস্যের খবর নেই। নিজেদের মতো করে ২২ বছরের পুরোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি চলছে এভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মা-মেয়ের প্রভাব এতই বেশি যে, সব কর্মকর্তা-শিক্ষকের মুখে কুলুপ। নাম প্রকাশ করে কেউ কিছু বলতে চান না।
ভার্সিটিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য থাকলেও তাদেরকে পুতুল করে রাখা হয়েছে। বিওটির বাইরে ফিন্যান্স থেকে অ্যাডমিশন সব জায়গার কর্তাব্যক্তিরা বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) আত্মীয়-স্বজন। এর ফলে নানা অনিয়ম দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে চললেও সেটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারকি সংস্থার নজরের বাইরে রয়েছে। গত বছর নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর তদবির ও নিজস্ব ক্যাম্পাসের কাজ চলমান দেখিয়ে আবারও ছাত্র ভর্তি শুরু করে। তবে দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠা হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যত লুটপাটের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) একাধিক অভিযোগ জমা দেওয়ার পরও নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট্রি মো. মনিরুজ্জামান বরিশালের একটি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে ৫ আগস্টের পর এখন তিনি পলাতক আছেন। আরেক আত্মীয় ইলিয়াস হোসেন মিরন আগে সরকারি চাকরি করতেন। অবসরের পর তিনি ট্রাস্ট্রি মেম্বার হন। সদস্য জাকির হোসেন আগে সক্রিয় ছিলেন। মিটিংয়ে অংশ নিতেন। তবে দীর্ঘদিন তার দেখা নেই। রুমানা হক রিটা পাঠাগার পরিচালক পদের সঙ্গে বিওটি সদস্য হিসেবেও যুক্ত আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, ধানমন্ডির কেয়ারি প্লাজায় একাধিক ফ্লোর, ধানমন্ডি ১৯ নম্বরে ভবনসহ ভার্সিটির টাকায় চারটি ভবন ছিল ওই এলাকায়। যার সবই বিক্রি করা হয়েছে। ধানমন্ডির ক্যাম্পাসের এসি, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল বিক্রি করা হয়েছে। এসব টাকার কোন হদিসও নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যেমন পেরেছে, সেভাবেই লুটপাট করেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট্রির আত্মীয় আগের ভবনে কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন।
লুটপাট ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি আত্মীয়করণের কারণে নানা দুর্নীতির বেড়াজালে আটকা পড়েছে। আইটি প্রধান থেকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, অ্যাডমিশন প্রধান সবাই বিওটি চেয়ারম্যানের নিকট আত্মীয়।
জানা যায়, ভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হেলালুজ্জামান বিওটি চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই। ডেপুটি কন্ট্রোলার মো. সিরাজুল ইসলামও আত্মীয়। ডেপুটি রেজিস্ট্রার ফজলে রব তাজ ফাতিনাজ ফিরোজের আপন ভাই। যিনি নিয়মিত অফিসে না এলেও বেতন পান। আরেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাফর আহমেদ তিনিও আত্মীয়। অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ফারুক কবীর নিকট বন্ধু। এছাড়াও রেজিস্ট্রার পদে রয়েছেন আব্দুল মতিন। যার প্রধান কাজ ট্রাস্ট্রিবোর্ডের অধীনে নিয়ম বহির্ভূত কাজ করা। অ্যাডমিশন প্রধান হিসেবে রয়েছেন আশিক। যিনি চেয়ারম্যানের ভাতিজা। লাইব্রেরির বোর্ড অব ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন রুমানা হক রিটা। হেড অব আইটি পদে আছেন আনিসুল হক ভুট্টো। তিনিও আত্মীয়। ফাইন্যান্সের প্রধান হিসেবে আছেন মোতাহার হোসেন। যিনি ফাতিনাজ ফিরোজের অত্যন্ত কাছের বন্ধু।
আরও জানা যায়, অনেকক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়দের অধিকাংশের বেতন দেড়-দুই ও তিন লাখ টাকার মতন। অনেকক্ষেত্রে একই পদে আত্মীয়দের বেতন দ্বিগুন। অন্যদিকে একই পদের কর্মকর্তার বেতন অর্ধেকেরও নিচে। যার ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও ব্যপক অসন্তোস রয়েছে।
ভার্সিটির একাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষকদের মধ্যে কথা বলে জানা যায়, তিন মাস পর এক মাসের বেতন পান ভার্সিটিতে কর্মরতরা। গত আগস্ট মাসের বেতনও অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী পায়নি। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘ সময় বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। এছাড়াও সম্প্রতি ৬ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এসব শিক্ষকদের দাবি, অন্যায়ভাবে তাদেরকে চাররি থেকে জোর করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও ১০ শিক্ষককে খুব শিঘ্রই চাকরিচ্যুত করা হবে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়াও করোনার সময় অনেক শিক্ষক-কর্মচারীকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাদের পাওনাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এমনকি এখন যারা কর্মরত আছেন করোনার সময় পাওনা বেতনও পরিশোধ করা হয়নি। মূলত যারা অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদেরকেই কোন কারণ ছাড়াই ছাটাই করা হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ জনকণ্ঠকে বলেন, সবাই যে আত্মীয় এটি সত্যি নয়। অনেকেই এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। নিজেদের বলয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক দিন হলো আমি ও আমার মেয়েরা ভার্সিটিতেই যাই না। এগুলো সব সত্যি নয়। ৩ মাসের বেশি সময় কেন বেতন না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, এটি সমাধানের চেষ্টা চলছে। আগামী সপ্তাহ থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। ধানমন্ডির এলাকার ভবনের বিষয়ে তিনি বলেন, এইগুলোর হিসাব আছে। আর এত কথা ফোনে বলা সম্ভব হয় না। আপনি অফিসে এসে বা সাক্ষাৎ করতে পারেন। একইসঙ্গে তিনি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ নামে কার্যক্রম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়টির একমাত্র ক্যাম্পাস সিদ্ধেশ্বরীতে অবস্থিত। দীর্ঘদিন এই ক্যাম্পাসকে স্থায়ী হিসেবে দেখানো হলেও এটি মূলত লিজ নেওয়া জায়গার ওপর গড়ে তোলা। বর্তমানে ইউজিসির চাপে ঢাকার মুগদার গ্রিন মডেল টাউনে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে এই ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এর ফলে এত পুরোনা ভার্সিটি এখনো ইউজিসির স্থায়ী সনদ পায়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৫ সালে প্রয়াত ড. এম. এ হান্নান ফিরোজের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখা স্টামফোর্ড কলেজ যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রদানের মূলমন্ত্র নিয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ যাত্রা করে। প্রতিষ্ঠানটিতে স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করার পাশাপাশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রীও প্রদান করা হয়। তবে এক সময় বিশাল শিক্ষার্থী এই ভার্সিটিতে অধ্যায়ন করলেও এখন শিক্ষার্থী খরায় রয়েছে। ভার্সিটি সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, শিক্ষার্থী ভর্তি, সেমিস্টার ফি হিসাবে শিক্ষার্থীরা যেসব টাকা জমা দেয়, নিয়ম অনুযায়ী তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার কথা হলেও তা ট্রাস্টির সদস্যরা লুটপাট করেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা বলছেন, প্রতিবছর ম্যানুপুলেট করে অডিটের মাধ্যমে উপরে উপরে সব ঠিক রাখা হয়েছে। বাস্তবতা হলো এই ভার্সিটির তেমন কোন ফান্ডই নেই। সব কিছু কাগুজে হিসাব রয়েছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. মোঃ ফখরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, এত অভিযোগ আমার বা আমাদের জানা ছিল না। এ বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডিভিশনের সঙ্গে আমি কথা বলবো। বর্তমানে আমি ও চেয়ারম্যান স্যার দেশের বাইরে আছি। তবে অবশ্যই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।