পরিবারের বড় সন্তান রেমী চাকমা। বাবা কৃষক, কোনোরকম কাজ করে সংসারের অভাব মেটান। এই অভাব-অনটনের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন রেমী। কিছু ভালো মানুষের সহযোগিতা না পেলে হয়তো সেই ছোটবেলায় বন্ধ হয়ে যেত রেমীর পড়াশোনা। আজ সেই রেমী পা রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। ভর্তি হয়েছেন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে। তার স্কুলজীবন শুরু নলছড়া ব্র্যাক স্কুল থেকে। এরপর বাড়ির আশপাশে কোনো সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় ভর্তি হন বাড়ি থেকে প্রায় ২-৩ কিলোমিটার দূরে মিলেনিয়াম ভাইবোনছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুলটি ছিল চেঙ্গী নদীর ওপারে। তাই বর্ষাকালে নদী পারাপার হতে বেশ সমস্যায় পড়তে হতো তাকে।
রেমীর বাবার রোজগারও তেমন ছিল না। কিন্তু ভালো ফলের জন্য স্কুলে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি রেমীকে। সেই স্কুলের শিক্ষক কুলিন চাকমা তাকে বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়াতেন। পড়াশোনায় ভালো করার কারণে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকাও রেমীর প্রতি ছিলেন বেশ আন্তরিক, তাদের সহযোগিতায় সেই স্কুল থেকে রেমীই প্রথমবারের মতো পান জিপিএ-৫। তারপর বাধে বিপত্তি। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পালা। বাড়ির আশপাশে ছিল না কোনো ভালো সরকারি কলেজ। ভালো কলেজে ভর্তি হতে হলে তাকে যেতে হবে খাগড়াছড়ি শহরে। কিন্তু পড়াশোনার খরচ চালানোর মতোন আর্থিক সামর্থ্যও তার পরিবারের কাছে ছিল না।
তখন তার এই অবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন তার স্কুলের শিক্ষিকা রমিতা দেওয়ান। তিনি রেমীর পরিবারকে আশ্বস্ত করেন উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনার দায়িত্ব নেবেন। এবং তার সহযোগিতায় রেমী প্রথম আলো পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন, সেখান থেকেও বেশ ভালো অনুদানও পান রেমী। সেই অনুদানের টাকা দিয়ে রেমী ভর্তি হন খাগড়াছড়ি সরকারি মহিলা কলেজে। শহরে তেমন কোনো পরিচিত না থাকায় রেমী উঠেন কলেজের হোস্টেলে। সরকারি হোস্টেল হওয়ায় মাসে লাগতো প্রায় ১২৫০ টাকা। সেই খরচগুলোও রেমীর বাবার একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় রমিতা দেওয়ান আবারও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন।
কলেজের রেজাল্ট তখনও পাননি রেমী। তার সব বন্ধুরাÑ কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল আর অনেকেই নার্সিংয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। রেমী বলেন, তাদের দেখে তারও খুব ইচ্ছা হয় কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার, ভালো প্রস্তুতি নিয়ে ভর্তি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার। তাই বাসায়ও বলেছিলেন কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার কথা। ভর্তি পরীক্ষার আর মাত্র ২-৩ মাস বাকি। এই সময়ে আমাদের গ্রামের প্রধান এগিয়ে আসেন। তিনি একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি তার নাম কোথাও বলতে মানা করেন। তার সাহায্য নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রস্তুতির জন্য কোচিংয়ের এক্সাম ব্যাচে ভর্তি হলাম। প্রস্তুতি নেওয়ার আর বেশি সময় পেলাম না। তারপর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। রেমী চাকমা বলেন, ‘এখনও অনেক দূর পার হওয়ার বাকি। এতদূর আসার পেছনে যাদের অবদানÑ পরিবার, শিক্ষকগণ এবং সেই আংকেলরাÑ যাদের কোনোদিন ভুলতে পারব না। তাদের সহযোগিতা না পেলে হয়তো সেই অজপাড়াগাঁয়েই পড়ে থাকতাম।
‘এতদূর যেহেতু এসেছি, সামনেও এগুতে চাই’
শীর্ষ সংবাদ: