ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

গণরুম জাদুঘরে কী ভাবছে শিক্ষার্থীরা?

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

গণরুম জাদুঘরে   কী ভাবছে শিক্ষার্থীরা?

মিরাতুস সামিরা
শিক্ষার্থী, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়
 
আমি মিরাতুস সামিরা। জাবির অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ৫৩ ব্যাচ। নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে উঠেছি বীর প্রতীক তারামন বিবি হলের ষষ্ঠ তলায়। অন্য শিক্ষার্থীর মতো বিশ^বিদ্যালয় নিয়ে আমারও দুশ্চিন্তা ও ভয় কাজ করেছে। তারপর গণরুম আতঙ্ক তো আছেই। নতুন পরিবেশ কেমন হবে, মানিয়ে নিতে পারব কিনাÑ এসব নিয়ে কিছুটা ভয়ভীতি দানা বেঁধেছে। কিন্তু নতুন হলো, নতুন রুম, করিডর, আশপাশের সহপাঠীদের পেয়ে সব কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এর মধ্যে পুরো হলেই সর্বোচ্চ সুবিধা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন হল প্রশাসন। ফলে পরিবারের দুশ্চিন্তাও অনেকটাই লাঘব হয়েছে। এভাবে গল্প-আড্ডায় বেশ ভালোই চলছে আমার নতুন হল জীবন।

মাহমুদ হাসান শুভ
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়

বর্তমানে ক্যাম্পাসে কোনো গণরুম নেই। ৫৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই নিজস্ব সিট পেয়েছে যা আমাদের জন্য একরকম স্বপ্ন ছিল। প্রায় দুই বছরের মতো গণরুম এবং মিনি গণরুমে ছিলাম। প্রতিটি রুমে আমরা ছিলাম ৪০-৫০ জন। সিঙ্গেল তোশকে ২ জন থাকতাম। ফলে বিভিন্ন রোগ লেগেই থাকতো। বিশেষ করে ছেলেদের গণরুমগুলো ছিল কমনরুম বা টিভি রুমের সঙ্গে। অতিরিক্ত শব্দের কারণে ঠিকমতো ঘুম হতো না। পড়ালেখার তেমন কোনো সুযোগই ছিল না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার ছিলাম আমরা। গণরুমের নিয়ন্ত্রণ ও আবাসিক হলের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের হাতে। কিছু কিছু সিনিয়র ভাইরা সরাসরি মাদক সাপ্লাই দিত। অনেক বন্ধু গণরুমে থেকে মাদকাসক্ত হয়েছে, যার সাক্ষী আমি নিজেই। বাবা-মাকে গালাগাল করা থেকে পর্নো নায়িকার অভিনয় এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের কায়দা-কানুনও শেখানো হতো গণরুমে। র‌্যাগিংয়ের ভয়ে ফুলহাতা শার্ট পরে হাতার বুতাম লাগিয়ে রাখতে হতো সারাদিন। ফাঁপর চলতো প্রতিদিন। ঝুলানো, মুরগি/পাখি হওয়া এবং লাফানো ছিল নিত্যদিনের বিনোদনের অংশ। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা শিক্ষাজীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল আনন্দ ও নিয়মতান্ত্রিকতা।
মাজমুর ওয়াস্তা ইলমা
শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়

দীর্ঘদিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় গণরুম কালচারমুক্ত। এ যেন স্বস্তির নিশ^াস। অথচ আমাদের নিজস্ব সিট পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরখানেক। দীর্ঘদিন গণরুমে থাকার ফলে নানা সমস্যা পোহাতে হতো। অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকাতে আড্ডা, গল্পগুজব, র‌্যাগিং, ওয়াশরুমের স্বল্পতা সবমিলিয়ে অনেক সময় অপচয় হতো। ফ্লোরিং করে থাকার কারণে বিছানায় ধুলোবালি জমতো বেশি। তাই ডাস্টজনিত সমস্যা বিশেষ করে যাদের এ্যাজমা, হাঁপানি আছে তাদের বেশি অসুবিধা হতো। ঘুমানো বা পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। গণরুমে যে কয়েকটা ফ্যান দেওয়া হয়েছিল তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। জিনিস রাখার জায়গাও ছিল খুবই কম। যার ফলে সহপাঠীদের সঙ্গে মনোমালিন্য লেগেই থাকতো।

শাহেদ শাহরিয়ার শোভন
শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়

সবসময়ই শুনে এসেছি যে বিশ^বিদ্যালয়ে গেলে গণরুমে থাকতেই হবে। কিন্তু জাবি প্রশাসন এবার গণরুম প্রথা বিলুপ্ত করেছে। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কারণ ২০২৪ সালে এসেও দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে গণরুম প্রথা থাকলেও তা আমাদের এখানে নেই। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সিঙ্গেল বেড ও টেবিল-চেয়ার দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে লেখাপড়ার একটি সুস্থ পরিবেশ আছে এখন। আর সেই সঙ্গে বিলুপ্ত র‌্যাগিং সিস্টেমের কথা না বললেই নয়। আমরা সবাই জানি পূর্ববর্তী সময়ে কেমন র‌্যাগিং সিস্টেম চালু ছিল, যার ফলে বিশ^বিদ্যালয় ত্যাগ থেকে শুরু করে সুইসাইডের মতো বড় বড় পদক্ষেপ নিত ভুক্তভোগীরা। ফলে সারাবছরই কোনো না কোনো ঘটনা শিরোনাম হতো পত্রিকার পাতায়। যা একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইমেজকে ক্ষুন্ন করতো মারাত্মকভাবে।
কিন্তু অবিশ^াস্য হলেও সত্য যে প্রায় ১৬ বছর পর এই প্রথম জাবিতে গণরুম প্রথাসহ র‌্যাগিং সিস্টেম বিলুপ্ত হয়েছে।
সব মিলিয়ে আমরা ৫৩তম আবর্তন, অনেক খুশি। পরিশেষে এটাই বলব যে আমরা যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতাম আজ আমরা তেমনি পেয়েছি।
আশা রাখছি যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রশাসন এই নতুন সংস্কার ধরে রাখতে পারবে।

×