ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা

অপকর্মে নিষেধ করায় সিনিয়রকে মারধর, নিউজ করায় অভিযোগ

হাবিপ্রবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৪:০২, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

অপকর্মে নিষেধ করায় সিনিয়রকে মারধর, নিউজ করায় অভিযোগ

অভিযুক্ত সাজ্জাদ।

অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখে ফেলায় বিগত ২৬শে অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী শামীম রেজাকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায় সামজবিজ্ঞান বিভাগের ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাজ্জাদের বিরুদ্ধে ৷ 

এরই প্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। লিখিত অভিযোগ দাখিলের পর ১৬ দিন পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ দেখা না যাওয়ায় গত ১০ই নভেম্বর ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর সহপাঠী, সিনিয়র ও জুনিয়ররা একত্রিত হয়ে দ্রুত বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করেন। 

সেই বিক্ষোভের নিউজ প্রকাশ করায় গত ১১ই নভেম্বর  বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যমকর্মীদের একমাত্র সংগঠন হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির বিরুদ্ধে অভিযুক্ত ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। 

লিখিত অভিযোগে বলা হয়,গত শনিবার (২৬শে অক্টোবর) আনুমানিক সন্ধ্যা ৬ টা ৫০ মিনিটের দিকে আমি এবং আমার বিভাগ ও এলাকার জুনিয়রের সাথে ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের ১৭ ব্যাচের রেজা নামক এক শিক্ষার্থী উগ্র আচরণ করেন এবং মেয়ে জুনিয়রকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেন। 

গত সোমবার (১০শে নভেম্বর) প্রশাসনিক ভবনে কতিপয় শিক্ষার্থী তালা মারে এবং রেজা নামের শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়ে কথা বলে কিন্তু উদ্বেগের বিষয় এই যে, হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি নেতিবাচক শিরোনাম দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে যেখানে মূল ভুক্তভোগী আমি ও আমার জুনিয়রের বক্তব্য নেওয়া হয়নি। কোনো প্রমাণাদি ছাড়াই এবং সত্যতা যাচাই না করেই বিভিন্ন পত্রিকায় এবং অনলাইন পোর্টালে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে।

হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মো. গোলাম ফাহিমুল্লাহ বলেন, ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে, তারা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে আবার সেই ভুল সিনিয়র ধরিয়ে দিলে তার রুমে ঢুকে মারধর করলে মানসম্মান নষ্ট হয় না, আর আমরা সেটা লিখলেই মান সম্মান নষ্ট হয়ে যায়। এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা। হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি সাংবাদিকতার সুষ্ঠু ধারা অব্যাহত রাখতে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যেকোনো অন্যায় অনিয়ম দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরে আসছে এবং সামনের দিনেও তুলে ধরবে। 

হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। বানোয়াট ও ভিত্তিহীন এইসব অভিযোগ করে হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে আমি মনে করি। 

শুধু সাংবাদিক সমিতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই থেমে  যায়নি অভিযুক্ত সাজ্জাদ ৷ সাংবাদিক সমিতির পর দ্রুত বিচারের দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলানো ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা পরিসংখ্যান বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী তপুসহ সকলের বিরুদ্ধে একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বরাবর আরও একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। 

আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়, গত শনিবারের (২৬শে অক্টোবর) ঘটনার প্রেক্ষিতে শামীম রেজার পক্ষ নিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ১৭ ব্যাচের তোফাজ্জল হোসেন তপু ও তার গ্যাংরা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা মেরে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার জন্য এই তপু গ্যাং কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তপু সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান যে, ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার বিচার চেয়ে অবস্থান কর্মসূচির কিন্তু তপু ও তপু গ্যাং সেই কাজ না করে ঘটনা অন্য দিকে মোড় দিয়ে উগ্র আচরণকারী রেজা নামক ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীর পক্ষ নেয় এবং তাকে নির্দোষী প্রমাণ করার জন্য আমাদের উপর দোষ চাপায়। এরকম অনেক অপ্রত্যাশিত কর্মকান্ড নিয়মিত করে যাচ্ছে এই তপু গ্যাং৷ তপু বিগত সময়ে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিল এবং সামনের সারি থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই সাথে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন আকাশের একান্ত আস্থাভাজন ছিল। 

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তপুসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তপু জানান, অভিযুক্ত সাজ্জাদ আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছেন সেগুলো সবই ভিত্তিহীন। গত ১০ই নভেম্বর আমরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা গত ২৬শে অক্টোবর শামীম রেজার ওপর যে হামলা চালিয়েছিলো সেই হামলার বিচারের দাবীতে প্রশাসনিক ভবনে দাঁড়িয়েছিলাম। অভিযুক্ত সাজ্জাদ আমাকে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে যে তকমা দিয়েছে সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। আসলে আমাকে যে তকমা দিয়েছে সে নিজেই বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের বিভিন্ন মিছিল মিটিং এ সক্রিয় ভাবে অংশ করেছিলেন। আর আমি যদি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হতাম তাহলে  ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা গত বছর কেনো আমার ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে আমার কানের পর্দা ফাটিয়েছিলেন, যার কারণে আমার কানের তিন ভাগের এক ভাগ শোনার সক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

অভিযুক্ত সাজ্জাদ ছাড়াও ওই দিনের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী তানজীম সাদিয়াও ১০শে নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং বিভিন্নভাবে হেনস্তার বিচার চেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। 

লিখিত ওই অভিযোগে বলা হয়,গত শনিবার (২৬শে অক্টোবর) আমি আমার বিভাগের এবং এলাকার সিনিয়র ভাইয়ের সাথে আনুমানিক সন্ধ্যা ৬ টা ৫০ মিনিটের দিকে ভেটেরিনারি ক্লিনিকের সামনে কথা বলি। হঠাৎ করেই এক জনৈক ব্যক্তি এসে উচ্চবাচ্য কথা বলা শুরু করেন। আমার সাথে উপস্থিত থাকা বড় ভাই তার পরিচয় জানতে চাইতেই তিনি আরও উত্তেজিত হোন৷ পরক্ষণেই আমাকে নিয়ে এবং আমার পরিবার নিয়ে অশালীন কথাবার্তা বলা শুরু করেন৷ সেই সাথে মারার জন্য উদ্যেত হোন৷ একটা পর্যায়ে তিনি নিজেকে প্রক্টর দাবি করেন এবং নিজেকে স্থানীয় পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি রেজা ডিভিএম ১৭ ব্যাচ, দেখি তোদের কোন বাপ আছে তাকে নিয়ে জিয়া হলের ১০৭ নাম্বার রুমে আসিস দেখ তোদের কি করি আমি, এমন হুমকি দিয়ে চলে যান। তাৎক্ষণিক আমি রুমে যায় এবং ভয়েস অব এইচএসটিউ নামক পেজে বগুড়াকে নিয়ে নেতিবাচক পোস্ট দেখি ৷ যা মূলত সন্ধ্যার সময় ঘটে যাওয়া ঘটনার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে ৷ সম্প্রতি ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি আইডি থেকে আমাকে অশালীন বার্তা লিখে মেসেজ করছে।

অভিযোগপত্র পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. শামসুজ্জোহা জানান, ১০ নভেম্বর প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি ছিল ২৬ অক্টোবর আবাসিক হলের রুমে ঢুকে রেজা নামের শিক্ষার্থীকে  মারধরের ঘটনার বিচার করা এবং শাস্তি নিশ্চিত করা। ওইদিনই আমরা ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং তদন্ত চলমান রয়েছে খুব দ্রুতই প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আমরা শাস্তির সুপারিশ করবো। আর অভিযুক্তরা যেসকল অভিযোগ করেছে সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখবো।

অভিযোগের বিষয়ে ভেটেরিনারি এন্ড এ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের ১৭ ব্যাচের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শামীম রেজা বলেন, আমাকে অভিযুক্ত করে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার সবই মিথ্যা। বিগত ২৬শে অক্টোবর সন্ধ্যার পর ল্যাবের কাজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সায়েন্স ভবনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এসময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ এক তরুণীসহ অপ্রীতিকর অবস্থায় বসে থাকতে দেখি। তখন আমি তাদেরকে খোলা জায়গায় এমন অপ্রীতিকর কিছু করতে নিষেধ করি। এরই এক পর্যায়ে সাজ্জাদ ক্ষিপ্ত হয়ে গেলে আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এসময় সাজ্জাদ বগুড়ার ছেলে পরিচয় দিয়ে আমাকে দেখে নেবে বলে । 

কথা কাটাকাটির পর আমি হলে আমার ১০৭ নাম্বার রুমে চলে আসি। রুমে আসার পর আনুমানিক রাত ১২ টায় ওই ঘটনার জের ধরে কয়েজন শিক্ষার্থী আমার রুমে আমার উপর হামলা করে বসে। হামলার ঘটনা জানতে পেরে হল প্রভোস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরাহ কয়েকজন শিক্ষক হলে ছুটে আসেন। এসময় তারা আমাদের দুইপক্ষের কথা শুনে সঠিক বিচারের আশ্বাস দেন এবং একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে বলেন। যার প্রেক্ষিতে আমি একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করি। কিন্তু অভিযোগ দাখিলের ১৬ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো সুরাহা হয় না। তখন আমার সহপাঠী তপুসহ, আমার সিনিয়র ও জুনিয়ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দ্রুত বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন ৷

আরো জানা যায়, অভিযুক্ত সাজ্জাদ ও তার দলবল নিষিদ্ধ সংগঠন হাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সক্রিয় ও প্রথম সারির নেতাকর্মী ছিল। ৫ আগষ্টের পূর্বে বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের দাপট দেখিয়ে হলের সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজির সাথে জড়িত ছিল বলেও জানা যায়।

নুসরাত

×