প্রতিবছর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে (ইইডি) কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়। নতুন ভবন, সংস্কার, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নই এই দপ্তরের কাজ। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীদের ম্যানেজ করে ১০ ঠিকাদারের জিম্মায় দপ্তরটি।
এর ফলে প্রকৌশলীরা যেমন উন্নয়ন কাজের মাসোহারা পেয়েছেন তেমনি দীর্ঘ সময় লাইসেন্সের মাধ্যমে কাজ করায় ১০ ঠিকাদারের জিম্মায় এখনো শিক্ষা প্রকৌশল। যা থেকে বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
অভিযোগ রয়েছে, এসব ঠিকাদারকে কাজ দিতে দরপত্রের শর্তের পরিবর্তন, আগে থেকে সর্বনিম্ন দরের তথ্য ঠিকাদারকে পৌঁছে দেওয়া ও কাজের আগেই হাজার কোটি টাকা বিল দেওয়ার শত শত অভিযোগ রয়েছে। যেসব প্রকৌশলী অনিয়মের শর্ত পূরণ করতেন না তাদেরকে অধিদপ্তর থেকে নানাভাবে নাজেহাল, ক্ষেত্রবিশেষে দপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সূত্রের দাবি, এসব ঠিকাদারের অনেকেই জেলে, নিখোঁজ ও অন্য ব্যক্তিকে দিয়ে কাজ পরিচালনা করছেন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরাও জনকণ্ঠকে নানা ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, যেসব ঠিকাদার হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা হলেন যুবলীগের ঈসমাইল হোসেন সম্রাট। যার কোম্পানির নাম সম্রাট ইন্টারপ্রাইজ।
ময়মনসিংহে ভাওয়াল ইন্টারপ্রাইজ নামে একটি বৃহৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল। হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ করে তাদের লাইসেন্স বড় হয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ায় অধিদপ্তর এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে। যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন ইইডি ঠিকাদারদের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। কিন্তু নানা অভিযোগের কারণে তিনি কারান্তরীণ আছেন।
মিরন ইন্টারপ্রাইজ নামে আরও একটি প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হাজার কোটি টাকার টেন্ডারে তাদেরও বড় ভূমিকা সবসময় দেখা গেছে। ঢাকা অঞ্চলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন মো. মিজান। বর্তমানে তিনি পালিয়ে দুবাইতে অবস্থান করছেন। তবে এই ঠিকাদারদের বিষয়ে প্রকৌশলীরা জানান, তিনি মূলত ফটকা ঠিকাদার ছিলেন।
নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করে সুবিধা আদায় করতেন। এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে জনকণ্ঠের সঙ্গে মো. মিজানের কথা হয়। তিনি জানান, তিনি দেশে অবস্থান না করলেও তার অনুসারীরা কাজগুলো দেখভাল করছেন।
আরও একটি বড় ঠিকাদারের নাম ঝন্টু, কুষ্টিয়ার সৈকত। আওয়ামী সরকারের আমলে তারাও শত শত কোটি টাকার কাজ প্রকৌশল থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন। এবং বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছে তা বিক্রি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তালিকায় রয়েছেন জাহাঙ্গীর কবির নানকের অনুসারী ফারুক, নানকের পিএস বিপ্লবসহ একাধিক ঠিকাদার।
কিভাবে কাজ পেতেন তারা শিক্ষা প্রকৌশলের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু পদ্ধতি রয়েছে। এলটিএম (লটারি) বা অটিএম বা রেট কোট। তবে অনেক ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রকৌশলীরা লেস বাইন্ডিংয়েও ঠিকাদারদেরকে কাজ দেওয়ার সুযোগ করে দিত।
ঢাকা অঞ্চলের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান শওকত। বর্তমানে তিনি নোয়াখালী ইইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন। কাজের দুর্নীতি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। ই-টেন্ডার করে ঠিকাদার মিজান শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে তিনি জানান।
সরকার এমন সিস্টেম করেছে যে ছোট ঠিকাদারদের কাজের সুযোগ নেই। কারণ বড় কাজ করতে হলে লাইসেন্সে কাজের অভিজ্ঞতা শত কোটি টাকা দেখাতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের নিয়ম পরিবর্তন করা উচিত। তা না হলে আগের মাফিয়ারাই প্রকৌশল দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করবে বলে তিনি মনে করেন।
যখন যে সরকার থাকে তখন তাদের লোক প্রভাব বিস্তার করে। যদি ইজিপিতে দরপত্র আহ্বান করা হয় নির্বাহী প্রকৌশলী যদি সৎ থাকে তবে বিশেষ কেউ কাজ পাবে এটা ঘটা সম্ভব নয়। কিন্তু দেখা যেত অনেকক্ষেত্রে নিয়মের বেড়াজালে সর্বনিম্ন দরদাতাকেও কাজ দেওয়া হতো না। তার কাগজের নানা ত্রুটি সামনে তুলে আনা হতো। যে কারণে প্রকৃত যারা কাজ পাবেন তারা না পেয়ে এটি রাঘব বোয়ালদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। যা এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। এ বিষয়ে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর ব্যবস্থা নেওয়ারও কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জানা যায়, এলটিএমে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত কাজে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই কাজ করতে গেলেই সবাই প্রধান প্রকৌশলীর কাছে ধরনা দিতেন। তারা প্রধানদের নানা ধরনের আনুকূল্য পেয়ে এসেছেন। লটারিতে টেন্ডারবাজির কোনো সুযোগও থাকে না।
তবে ওটিএমেও কিছু ঝামেলা আছে বলে মনে করেন কিছু প্রকৌশলী। তারা জানান, অনেক সময় অফিসের অসাধু কর্মচারীরা সর্বনিম্ন দর ঠিকাদারকে জানিয়ে দিত। সে অনুযায়ী দুর্নীতির মাধ্যমে এসব মাফিয়া ঠিকাদার একাধিক লাইসেন্সের নামে দরপত্র কিনত। পরে তারা দর পরিবর্তন করে জমা দিয়ে বড় কাজ বাগিয়ে নিত।
বর্তমান কাজ নিয়ে কি ভাবছে ইইডি ॥ শিক্ষা প্রকৌশলের অনেক কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। কবে হবে তার নির্দেশনাও নেই। এ বিষয়ে একাধিক দিন প্রধান প্রকৌশলী রুটিন দায়িত্ব রায়হান বাদশাহকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সমীর কুমার রজক দাসের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, অনেকের কাজের প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। আবার কোথাও ৮০ শতাংশ। ইইডি থেকে বাকি কাজের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা পলাতক রয়েছেন তাদেরকে বাদ দিয়ে পুনর্দরপত্র আহ্বান করা হবে। এরপর ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করা হবে।