ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১

গুণগত মান নিয়ে আপোস করবে না এনসিটিবি

চলতি সপ্তাহে শুরু হচ্ছে পাঠ্যবই ছাপার কাজ

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

চলতি সপ্তাহে শুরু হচ্ছে পাঠ্যবই ছাপার কাজ

চলতি সপ্তাহে শুরু হচ্ছে পাঠ্যবই ছাপার কাজ

দরপত্র আহ্বানে দীর্ঘসূত্রতা, বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বান ও বইয়ের বিভিন্ন অংশ সংযোজন বিয়োজন করায় এখনো বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে আশার কথা এখন প্রাথমিক স্তরের সব পর্যায়ের সব কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে অনুমোদন মিললেই চলতি সপ্তাহে শুরু হবে বই ছাপার কাজ।
সূত্র বলছে, বই ছাপার ক্ষেত্রে নতুন করে একটি সমস্যা  তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে প্রাক্কলিত দর থেকে বেশি দামে টেন্ডার আহ্বান করছেন। এতে সরকারের খরচও বাড়ছে। এ বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল। এ ছাড়া শুধু ১০ম শ্রেণির জন্য অতিরিক্ত ৫ কোটি বই বেশি ছাপাতে হবে। আগে বই ছাপাতে ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও এবার তা দুই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে। 
পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশকরা জানান, আশা করা যাচ্ছে প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই জানুয়ারির এক তারিখেই শিক্ষার্থীদের হাতে উঠবে। ডিসেম্বরের  ভেতর দেশের সব উপজেলায় ক্লাস ৪ ও ৫ এর বইও পৌঁছে যাবে। তবে বিপত্তি তৈরি হবে মাধ্যমিক স্তরের বই নিয়ে।
এ বিষয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় এনসিটিবির (টেক্সট) সদস্য রিয়াদ হোসাইনের সঙ্গে। তিনি জানান, রবিবার অষ্টম শ্রেণির দরপত্র সম্পন্ন হবে। তবে নবম ও দশম শ্রেণির জন্য বলার মতো তেমন কিছু নেই। কারণ ওসব বইয়ের এখনো অনেক কন্টেন্ট সংযোজন ও পরিমার্জন করা হচ্ছে। তিনি অক্টোবরের মধ্যেই এই দুই শ্রেণির টেন্ডার আহ্বানে আশাবাদী বলে জানান।
এনসিটিবির সদস্যরা জানান, এ বছর বইয়ের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে শিক্ষা উপদেষ্টা বিশেষ আন্তরিক। যে কারণে কাগজ, প্রিণ্টে কোন ছাড় দেওয়া হবে না বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে।
সদস্য রিয়াদ হোসাইন জানান, নবম ও দশম শ্রেণির টেন্ডার এই মাসে আহ্বান করা হবে। এর পর কমিটির অনুমোদন, যাচাই-বাছাই, নোয়াতে যাওয়ার পর ছাপার কাজের অনুমতি মেলে। সমস্যাটা হচ্ছে অনেক আগেই টেন্ডার করা হয়েছিল। পরে বাতিল করে সময় চলে গেছে। আমরা আশা করছি পান্ডুলিপির সিডি আমরা প্রাথমিকের যারা কাজ পেয়েছেন তাদের দেওয়া হবে। সেটি তারা ছাপিয়ে আমাদের দেখাবে। পরে অনুমোদন পেলে এর পর ছাপাখানায় শুরু হয়েছে।
২০১২ সালের কারিকুলামের কারণে এবার বই ছাপতে হবে প্রায় ৪০ কোটি। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ও বাকি ৩১ কোটি মাধ্যমিক স্তরে। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাপাখানা মালিকরা বলছেন, প্রতিবছর মে-জুন মাসে বই ছাপার কাজ শুরু হয়। অক্টোবরের শেষে বইয়ের অর্ধেক ছাপানো শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখনো সব টেন্ডার প্রক্রিয়ায় শেষ হয়নি। যে কারণে কিছু বই জানুয়ারিতে আর অধিকাংশ বই শিক্ষার্থীদের হাতে উঠতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত লাগতে পারে।
ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, এবার বইয়ের শর্তে কাগজের মান ৮৫ জিএস করা হয়েছে। যার জন্য ভার্জিন পাল্প প্রয়োজন। আর এই ধরনের কাগজ সরবরাহ করে দেশের মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান। আবার একই সময় ছাপার কাজ শুরু হওয়ায় একদিক দিয়ে কাগজের মান যেমন বাড়বে তেমনি শ্রমিক সংকটও দেখা দেবে।
এনসিটিবির নিয়ম অনুযায়ী কোনো দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বানের জন্য অন্তত ২১ দিন সময় লাগে। এর পর দরপত্র মূল্যায়নে ব্যয় হয় আরও ২০ দিন। ক্রয় কমিটির যাচাই-বাছাই ও ছাড় করতে লাগে অন্তত ১৫-২০ দিন। কাজের অনুমোদন মেলার পর (নোয়া) আরও ২৮ দিন সময় ব্যয় হয়।
এ কারণে পুস্তক ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়েছিলেন, বইয়ের দরপত্র মূল্যায়ন যেন কাগজের ফর্মা অনুযায়ী হয়। কাজ শেষে টাকাও নির্ধারণ হয় ফর্মা আকারে। সেক্ষেত্রে কারিকুলামে পরিবর্তন বা নতুন কিছু সংযোজন বিয়োজন হলেও কাজের অসুবিধা নেই। কিন্তু দরপত্র বাতিল করা মানে বইয়ের কাজ শুরু করতে অন্তত ২ মাস পিছিয়ে যাওয়া। সেকারণে বইয়ের দরপত্র বাতিল না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু বইয়ের দরপত্র পিছিয়ে যাওয়ায় ছাপার কাজও পিছিয়ে গেছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টদের ধারণা তড়িঘড়ি করে বই ছাপানোর কারণে এবারও বইয়ে ভুলভ্রান্তি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কোমলমতি শিক্ষর্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সরকারের বিনামূল্যের বইয়ে ভুল কিছুতেই ঠেকাতে পারছে না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রতিবছর নতুন বইয়ে মারাত্মক ভুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তা নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে ঢের। গত বছরও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩১ বইয়ে ১৪৭টি ভুল পায় কারিকুলাম প্রণয়ন ও বই বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের গঠিত কমিটি। স্কুলে স্কুলে সংশোধনী পাঠানোও উদ্যোগ নেয় তারা।
সেবার সংশোধনী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, গণিত, ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান ও ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞানসহ প্রায় সব শ্রেণির বইয়ে ভুল পাওয়া গেছে। কোনো ক্ষেত্রে এসব ভুল সংশোধন করা হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে একবারেই বাদ দেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা বইয়ের ২৪ পৃষ্ঠার ৭ নম্বর লাইনে আছে পৃথিবীতে যত মহাপুরুষ আছেন তাঁরা সবাই শীলাবান। যা ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম এনসিটিবি। এ কারণে লাইনটি একেবারেই বাদ দেওয়া হচ্ছে।

অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) বইয়ের ১২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘প্লাটিপাস মেরুদ-ী প্রাণী হলেও ডিম পাড়ে।’ এ তথ্যটি ভুল। প্রকৃত তথ্য হলো প্লাটিপাস মেরুদ-ী নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী। আবার একই বইয়ের ৯৩ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে, ‘হাইড্রোজেন ও পানির বিক্রিয়ায় পানি উৎপন্ন হয়’। সঠিক হবে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় পানি উৎপন্ন হয়। 
এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক, ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিক স্তরের ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ছাপানো হয়েছে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭ কপি। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের মোট বই ১৮ কোটি ৬১ লাখ ১ হাজার ২০৬টি। অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য ছাপানো হয়েছে ১০ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বই। আর প্রাথমিক স্তরের মোট বই প্রায় ৯ কোটি ৫০ লাখ। এ ছাড়া ইবতেদায়ির জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৫টি বই ছাপা হয়েছে। কিন্তু এবার সেটি ৪০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসান জনকণ্ঠকে জানান, এবার নির্ভুলভাবে বই ছাপানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন সবাই আধুনিক মেশিনে বই ছাপায়। যেকারণে কাজের অনুমতি পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যেই বই ছাপানো সম্ভব। এ ছাড়া জানুয়ারির এক তারিখে শিক্ষার্থীরা বই পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

×